কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৪)
কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৪)
আমি ভাবছি আর
ভাবনাবাবুর মতিগতি লক্ষ করছি, কুত করার চেষ্টা করছি সে আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে
চাইছে। ভাবনাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বল তো, পশুপতিকে দেখে আর কিছু মনে
পড়ছে না, আমি স্বভাব দোষে ঘাড় নাড়িয়ে জানিয়ে দিলাম, না; ভাবনাবাবু বললেন, সে কী
রে, তুই স্ফিংসের মূর্তির কথা ভুলে গেলি, মিশরের পিরামিডের উপরে সেই যে সিংহ-মানুষ,
যার শরীরটা সিংহের কিন্তু মাথাটা মানুষের মতো। তার দুপাশে আবার দুটো ডানাও জুড়ে
দেওয়া হয়েছে। পিরামিডের মাথায় সে সগর্বে বসে আছে ধনরত্নের প্রহরী হিসেবে। আমি সায়
দিয়ে বললাম, তা বটে, একদম মনে ছিল না বস। ভাবনাবাবু বললেন তোর আর দোষ কী, এর আগে
তো কেউ পশুপতির সঙ্গে স্ফিংসকে মেলাতে যায়নি। কারণ পিরামিড, মিশর, মমি, স্ফিংস এসব
বিরাট বড়ো বড়ো ঘটনা, অভিজাত ব্যাপার-স্যাপার, মিশরের বা গ্রিকের রূপকথায় তাদের
নিয়ে কত গল্প-কাহিনি, তার সঙ্গে হরপ্পার ওই সামান্য পশুপতির মূর্তিকে আর কোন
আহাম্মক মেলাতে যাবে বল। আমাদের নজরটা তো সব সময়ে উপরের দিকে থাকে, মানে গজদন্ত
মিনারের দিকে, আমরা মাটির দিকে তো তাকিয়ে দেখি না সেখানে কী ঘটছে; কিন্তু ভেবে দেখ
দুটো মূল আইডিয়া কিন্তু এক, মানুষের শক্তির সঙ্গে পশুশক্তিকে মিশিয়ে তৃতীয় এক তৃতীয়
শক্তির কল্পনা করা, যা আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হবে এবং যার সঙ্গে প্রচুর অলৌকিকতা
জড়িয়ে যাবে। হরপ্পার পশুপতিকে দেখ, তার চারপাশ থেকে উঁকি মারছে, হাতি মোষ বাঘ গণ্ডার আর মূর্তিটার আসনের নীচে দুটো হরিণ। এর
মধ্যেও কিন্তু অনেক বার্তা আছে; কিছু বুঝতে পারছিস। আমার উত্তরের তোয়াক্কা না করে
ভাবনাবাবু বলেই চলেছেন, তাঁকে যেন এখন একটা বলা-ভূতে পেয়েছে; তিনি বলেন, দেখ ওই
পশুদের মধ্যে কিন্তু কোনো বলদ নেই, অথচ হরপ্পা সভ্যতায় বলিবর্দের মূর্তির ছড়াছড়ি, বলদ
তো পোষ-মানা পশু; তার মানে প্রত্ন-শিবের চারপাশের ওই পশুরা কেউ মানুষের গৃহপালিত
বা পোষা পশু নয়, ওরা বন্য পশু। আদি-শিব হিসেবে কথিত ওই মূর্তিটাকে তারা ঘিরে আছে,
যেন সেই পশু-মানুষ তাদের রক্ষাকর্তা। এটা গেল মূর্তিটার একটা দিক, আবার অন্যদিকে
মূর্তির বসার ভঙ্গিমাটা একেবারে যোগীর মতো। যেন হরিণ-আঁকা আসনে বসে তিনি গভীর তপস্যা
করছেন। আজকে যোগের নামে চারপাশে যে অনুলোম-বিলোমের এত ফোঁস-ফোঁস আওয়াজ শুনতে পাস
তারও উৎস কিন্তু ঐ পশুপতি-শিব। আরো একটা ব্যাপার দেখ, মূর্তিটার ওই উত্থিত লিঙ্গ। তার মানে হরপ্পার
মানুষেরা ওই লিঙ্গেরও পুজো করত। যে-কারণে ঋকবেদ-সংহিতায় বহিরাগত আর্যরা এদেশের
মানুষকে বলেছে তারা ‘শিশ্ন-দেবা’, মানে লিঙ্গ-পূজক। এই মূর্তি থেকেই হয়ত পরবর্তী
সময়ে মূর্তি বাদ দিয়ে শুধু তার লিঙ্গটাকে নিয়ে তাকেই শিবলিঙ্গ বানিয়ে তার উপাসনা
শুরু হয়েছে। আর একথা তো বিশেষজ্ঞরা জানিয়েও দিয়েছে যে হরপ্পা-সভ্যতার মাটি খুঁড়ে
যে-সব নিদর্শন পাওয়া গেছে তার মধ্যে একটা বড়ো অংশের আকার লিঙ্গ ও যোনীর মতো।
অর্থাৎ সেখানে একই সঙ্গে লিঙ্গ-পূজা ও মাতৃ-পূজার প্রচলন ছিল। পরবর্তী লোকায়তিক
ধারা বেয়ে বৈদিক দেবতাদের কোনঠাসা করে এই বঙ্গভূমির মানুষদের মধ্যে শিবশক্তি আর
মাতৃশক্তি আরাধনার ঢল নেমেছে। তাহলে ভেবে দেখ, একটা যোগীমূর্তির থেকে
হরপ্পা-সভ্যতার মানুষের চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে কত রকম বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। এটাও
বোঝা যাচ্ছে এ ব্যাপারে সেইসব মানুষ কতখানি উন্নত ছিল। কী আর বলব, আমি তখন থ হয়ে তাকিয়ে
আছি।
মন্তব্যসমূহ