কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৫)
কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৫)
মাথার মধ্যে ঘুর-ঘুরে পোকার কারবার আমাকে মাঝে মাঝে অস্থির করে দেয়। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার ভাবনাবাবুর হানাদারি। আসলে ভাবনাবাবুই আমার সেই ঘুর-ঘুরে পোকা। আমাকে সে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে থাকে, এটা কী, ওটা কেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, দূর-দূর, ভাবনার যখন কোনো আদি-অন্ত নেই, তখন এত ভেবে সব সময় নিজেকে ব্যতিব্যস্ত করে কী লাভ? আর কিছু ভাবব না। চুপচাপ বসে থাকব, শুয়ে থাকব, নিশ্চিন্তে ঘুমোব্ টিভি দেখব, মোবাইল সার্ফ করব। আমা্দের কর্তাবাবুরাই তো বলে গেছেন, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে কী হবে? এবার বরং চার্বাক-বাবার শিষ্য হয়ে যাব, খাও-পিও-জিও। মনে তো অনেক কিছুই হয়, কিন্তু টিভির ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগে না, মোবাইলেও বিরক্ত আসে; তখন আবার ভাবনা আসে, কিছু না ভেবে থাকতে পারি কই। মনুষ্য-জন্মের বোধহয় এই এক জ্বালা। সারা-জীবন শুধু ভেবে যাও। আর এটা পড়ো, ওটা পড়ো, একে জিজ্ঞেস করো, ওর আলোচনায় যোগ দাও, ইত্যাদি। সুতরাং ভাবতেই হয়, আর অমনি ভাবনাবাবু এসে হাজির। সেদিন তো হরপ্পা-সভ্যতার পশুপতির সঙ্গে মিশরের স্ফিংসকে মিলিয়ে দিল, আজ আবার কী বলে দেখি। বুঝেছি বুঝেছি, তুই পশুপতি আর স্ফিংস নিয়ে ভাবছিস তো, আরে গল্প তো ওখানে শেষ হয়নি, এই রকম হাইব্রিড-মূর্তির গল্প আরো আছে। এই রে, গল্প আরো আছে, মানে ব্যাটা আরো জ্বালাবে। অতঃপর অপেক্ষা, বাবু নতুন কোন জ্ঞানভাণ্ডারের দরজা খোলে দেখি। ভাবনাবাবু বলল, তুই তো এক সময় খুব গোয়েন্দা-কাহিনি পড়েছিস। তোর পছন্দের ডিটেকটিভ কে। বললাম অবশ্যই ফেলুদা। ভাবনাবাবু মুচকি হেসে বলল, তাহলে কি তোর সেই গল্পটার কথা মনে আছে, সেই যে একদিন সকালে ফেলুদা তোপসেকে ট্যাক্সি করে ম্যাডক স্কোয়ারের নীলমণিবাবুর বাড়িতে গেল। আমি গড়গড় করে বলে গেলাম হ্যাঁ, হ্যা্ ট্যাক্সি থেকে নেমে এক টাকা সত্তর পয়সা ট্যাক্সিভাড়া মেটাতে ফেলুদা ড্রাভারকে দুটাকার নোট দিয়েছিল, বাকিটা ফেরৎ নেয়নি। ভাবনাবাবু বলল, গুড, তাহলে বল, সেদিন নীলমণিবাবুর সঙ্গে ফেলুদার কী নিয়ে কথা হয়েছিল? বললাম, কেন, অ্যারাটুন ব্রাদ্রার্সের নিলাম থেকে কেনা বিঘত্খানেক লম্বা আনুবিসের মূর্তি নিয়ে। গল্পটার নামও তো তাই ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’; ভাবনাবাবু খেইটা ধরে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, শেয়াল দেবতা আনুবিস মানে মিশরীয় মাইথোলজির গড অফ দ্য ডেড, মৃত আত্মাদের সেবতা। তার দেহটা মানুষের মতো হলেও কিন্তু মুণ্ডুটা শেয়ালের। তার মানে এখানেও একজন পশু-মানুষকে দেবতা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আনুবিসের ক্ষমতা নিয়ে আরো বেশি জানার ইচ্ছে থাকলে একটু নেট সার্চ করে দেখে নিস। তবে মুল ব্যাপারটা হচ্ছে, প্রাচীন সভ্যতার মানুষদের, সে হরপ্পা হোক কিংবা মিশরীয়, তাদের চিন্তার মধ্যে কী আশ্চর্য মিল দেখ। তবে দুর্ভাগ্য কী জানিস আজকের বিশেষজ্ঞরা স্ফিংস বা আনুবিস নিয়ে যত বেশি আগ্রহী বা পণ্ডিতদের মধ্যে তাদের কথা যতটা আলোচিত হয়, পশুপতির মূর্তির কথা ততটা হয় না। হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলোর উপরেই প্রচারের সব আলো ফেলা হয়, বেশিরভাগ সময়েই সেখানে পাওয়া মূর্তি সিলমোহর খেলনার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা উপেক্ষিত থাকে। বরং গবেষকদের আগ্রহ বেশি হরপ্পা-লিপি নিয়ে। তার পাঠোদ্ধারের পিছনেই তারা বেশি সময় দেয়। অথচ এই মুর্তিগুলোর ভেতরেও যে অনেক বার্তা আছে তা ডিকোড করার চেষ্টা করে না। তোর মাথায় যে প্রশ্নগুলো ঘুর-ঘুর করে সেগুলো তাদের মাথায় কেন এল না কে জানে, হয়ত তুই বড়ো বেশি ফেলুদা পড়ে ফেলেছিস। এটা ফেলুদা-এফেক্ট।
মন্তব্যসমূহ