কে যেন ঘুর ঘুর করে (১১)
কে যেন ঘুর ঘুর করে (১১)
এক সময়ে গায়ত্রী
চক্রবর্তী স্পিভাক প্রশ্ন তুলেছিলেন, Can the subaltern speak?’ শ্রদ্ধেয় অমর্ত্য সেন তাঁর বই The Argumentative Indians-এর
ভূমিকায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন-“ Just before the general elections in the spring of 2004, when I visited a Bengali village not far
from my own home, I was told by a villager, who was barely literate and
certainly very poor ‘It is not hard to silence us, but that is not because we
cannot speak.” পুরুষ-শাসিত সমাজে গড়পড়তা নারীকেই subaltern-এর দলে ফেলা
যায়। বেশিরভাগ সময়েই তাঁরা খুবই নিঃশব্দে সংসার-ধর্ম পালন করেন, সংসারকে সুন্দর
করে সাজিয়ে তোলেন এবং সমাজ ও সংসারের নানান অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, বঞ্চনা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হন।
বহু যুগ আগে বৈদিক সমাজে কিন্তু প্রথম প্রতিবাদটা ধ্বনিত হয়েছিল সেই নারী-কণ্ঠেই।
সে-প্রতিবাদ ছিল অবশ্যই পুরুষ-অহমিকার বিরুদ্ধে। সেই একমেবাদ্বিতীয়ম নারীটির নাম
‘বাক’। আজ আমরা বাক্-দেবী নামে যে সরস্বতী-ঠাকুরের পুজো করি ইনি সেই বাক্-দেবী
নন; ইতি একজন ঋষিণী, অম্ভৃণ নামের এক আর্য-ঋষির কন্যা।
গতানুগতিক রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁর রচিত স্তোত্রে স্পর্ধার সঙ্গে তিনি নিজের
বয়ানে নিজেকেই পরমাত্মা বলে ঘোষণা করলেন; গোষ্ঠী-চেতনায়-সমৃদ্ধ বৈদিক
স্তোত্রে ‘আমি’, আমি’ বলে এই আত্মঘোষণা আগে দেখা যায়নি; এতদিন বৈদিক-সমাজ পিতা-পুত্র অথবা
গুরু-শিষ্যের অঙ্ক নিয়েই মত্ত ছিল। সেখানে হঠাৎ করে গদা-হস্তে এক নারীর প্রবেশ এবং
সব অঙ্কই লণ্ড-ভণ্ড। শুধু তাই নয়,
নাম করে করে সমস্ত পুরুষ দেবতাদের মহত্বকে খাটো করে ওই নারী জানিয়ে
দিলেন, তাঁরা সকলেই
তাঁরই অংশমাত্র, তিনিই এই জগতের আসল সৃষ্টিকর্ত্রী। বাক-রচিত সেই
বাক-স্তোত্র বা দেবী-স্তোত্রের ঋকগুলো বড়ো অদ্ভূত। তিনি যা বললেন সংক্ষেপে তা এই
রকম— আমি রুদ্র, বসু, আদিত্য এবং বিশ্বদেবতারূপে চলাফেরা
করি। আমিই মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমার দুজনের ধাত্রী। আমি জগতের অধিশ্বরী, ধনদাত্রী।
আমি সাহায্য করি বলেই সকলের ভোজন, দর্শন, শ্রবণ ও
জীবনযাপন সম্ভব হয়। আমাকে যারা জানে না, তারা ক্ষয়ে
যায়। হে বিদ্বজ্জন শোনো, আমি
যা বলছি তা শ্রদ্ধার যোগ্য। যারা স্তোত্র মানে না, তাদের হত্যা করার জন্যে রুদ্র যখন ধনুক হাতে তুলে নেয়, তখন আমি তাতে জ্যা জুড়ে দিই।
সৎ-লোকেদের পক্ষে আমি যুদ্ধ করি। দ্যুলোক-ভূলোক জুড়ে আমি আছি। দেবতা ও মানুষ যাঁর
শরণ নেয়, তাঁর বিষয়ে আমিই উপদেশ দিই। আমি স্বয়ং ব্রহ্মা, যাকে খুশি আমি মেধাবী ও বলবান বানিয়ে
দিতে পারি। যে-আকাশ এ-জগতের মাথায় থাকে, তাকে আমিই জন্ম দিয়েছি। সমুদ্রের জলেও আমি
আছি, সেখান থেকেই আমি
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ি। নিজের শরীর দিয়ে আমি পৃথিবীকে ছুঁয়ে থাকি। বাতাসের মতোই
স্বাধীনভাবে প্রবাহিত হয়ে আমি সব কাজ করি। আমার মহিমা দ্যুলোক-ভূলোক সব কিছুকেই
ছাড়িয়ে গেছে, ইত্যাদি। ঋকবেদ-সংহিতার এই ১২৫ নম্বর স্তোত্রটির স্পিরিট দেখেই বোঝা
যাচ্ছে, ঋকবেদ-সংহিতার সেই সময়ে দেব-কল্পনায় পুরুষ-আধিপত্যের বিরুদ্ধে ‘বাক্’
নামের সেই নারী কত তীব্রভাবে ফুঁসে উঠেছিলেন। নারীসূক্তের মন্ত্রগুলোর মধ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে
কিন্তু নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী-কবিতার সুর শুনতে পাই। কী অদ্ভূত বৈপরীত্য দেখুন, পুরুষ-সূক্ত
যেমন সারা ভারতবর্ষের সমাজে জাতি-বিদ্বেষ ও বর্ণ-বিদ্বেষের বীজ ছড়িয়ে দিয়েছে, একটু মনোযোগ দিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, নারী-সূক্তে তেমনি পরবর্তীকালের সমস্ত
বিদ্রোহের বীজ নিহিত আছে। দুর্ভাগ্য, আমাদের সমাজে পুরুষ-সূক্ত যেভাবে এবং যতটা প্রচারিত
নারী-সূক্ত ঠিক ততটাই অবহেলিত অ অপ্রচলিত; পুরুষ-শাসিত সমাজে এই
সূক্তকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রচারের আলোর বাইরে রাখা হয়েছে। তারই মধ্যে
শুভ-সংবাদ এটাই যে বেদ যারা সংকলন করেছিলেন, ভয়ে হোক ভক্তিতে হোক,
তাঁরা বেদ থেকে নারী-সূক্তকে
বাদ দিতে পারেননি। তার মানে তখনো ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের যুগ শুরু হয়নি।
মন্তব্যসমূহ