কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৭)

 কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৭)

ভাবনাবাবুর ভাষণ শুনে আমি থ হয়ে ঘেমে থস থস করছি, মনে পড়ছে সেই কবে অবন-ঠাকুর লিখে গেছেন ‘মাথাটা যেন বাংলা খবরের কাগজ, মূল্য দুই পয়সা মাত্র’, আজকের দিন হলে তিনি নিশ্চয় খবরের কাগজের জায়গায় বাংলা সিরিয়াল লিখতেন। আমার নাতির আবার গণেশের মূর্তি খুব ফেভারিট। সে সিন্থেটিক ক্লে দিয়ে গণপতি-বাপ্পার মূর্তি বানায়, তার ড্রয়িংখাতায় সেই মূর্তির ছবি আঁকে, সঙ্গে ইঁদুরটাকে জুড়ে দিতে ভোলে না। তাই দেখে সবজান্তা গামছাওলা আবার শুরু করলেন, তাহলে বোঝ, কোথাকার একটা তুচ্ছ ইঁদুর তাও শেষ পর্যন্ত সর্ব-বিঘ্ননাশক গণদেবতার বাহন হয়ে গেল।  এটা গেঁড়ি-গুগলি-কাঁকড়ি-খাওয়া মাথা ছাড়া ওই ঘি-দুধ-মাখনে পুষ্ট ভদ্রলোকেদের মগজে কখনো আসত?  এবার আসা যাক আরেক হাইব্রিড মূর্তির কথায়; তিনি আবার বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার বাবা নৃসিংহদেব। স্ফিংসের ছিল সিংহের দেহ আর মানুষের মুণ্ডু, আমাদের অবতারের বেলায় দেখ, সেটা আবার কেমন উলটে গেল। তেনার আধাআধি। দেহের নীচের দিকটা মানুষের আর উপরের দিকটা সিংহের।   তুই যদি বিষ্ণুর অবতারের  রূপগুলো পরের পর সাজিয়ে দেখিস তাহলে ডারুইনের থেয়োরির একটা ছায়া দেখতে পাবি। প্রথমে জলচর, মৎস্য মানে মাছ, তারপরে উভচর  কূর্ম, মানে কাছিম, তারপর স্থলচর বরাহ, মানে শুয়োর। আচ্ছা বল তো, এই বরাহ বা শুয়োর যখন স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার তখন কাউকে বরাহনন্দন বা শুয়োরের বাচ্ছা বললে সেটা গালাগাল হয়ে যায় কেন।  সেই হিসেবে আমরা সকলেই তো কেষ্টর জীব মানে বরাহনন্দন। যাক, তাহলে বরাহ থেকে বামনের মাঝখানে নৃসিংহ অবতারের কল্পনাতেও একটা হরপ্পা এফেক্টের গল্প চলে আসছে।  তার সেকালের লোকভবনার পিছনে একটা লজিক কাজ করেছিল। বিজ্ঞান-চিন্তা কাজ করেছিল।  অথচ সেসব কিছুকে আমরা পাত্তাই দিই না। এগুলো কোনোদিনই বিদ্যায়তনের গবেষণার বিষয় হয়ে উঠল না।  কী জানি , তার পিছনে হয়ত ধর্মদ্রোহীতার একটা লুকোনো ভয় কাজ করেছে।  ভাবনাবাবুর কথাগুলো শুনে বেশ মজা লাগছে, হাসিও পাচ্ছে, তাই তাকে এখন আর থামানোর চেষ্টা করছি না, বাধাও দিচ্ছি না।  হঠাৎ ভাবনাবাবু প্রশ্ন করে বসলেন, আচ্ছা এই সব হাইব্রিড প্রাণির গল্প শুনে তোর সুকুমার রায়ের কথা মনে পড়ছে না, খিচুড়ি কবিতটার কথা মনে পড়ছে না? হাঁসজারু, বকচ্ছপ বা হাতিমির কথা মনে পড়ছে না? নিমেষে মনে হল তাই তো। এসন তো এর আগে কখনো মনে হয়নি। কিন্তু এসব তো ননসেন্স।  নিতান্ত মজার ছলে লেখা।  ভাবনাবাবু বললেন, শুধুই মজা নয় রে পাগলা, এমন ভাবনা তো আর মাথায় এমনি এমনি আসে না, রাতারাতি হঠাৎ করে উদয় হয় না; তার পিছনে একটা সুদীর্ঘ হয়ে ওঠা থাকে।  যাক, আমাদের ভগবানের নৃসিংহ-অবতারের সঙ্গে কিন্তু আরো একটা একটা গল্প আছে।  এ গল্প অনেকেই জানে না। সেটাও কিন্তু কম মজার নয়।  গল্পটা দেবাদিদেব মহাদেবের শরভেশ্বর বা শরভ অবতারের। সিংহের বড়ো বড়ো নখ দিয়ে হিরণ্যকশুপুরের পেট চিরে মেরে  তার রক্ত-মাংস খেয়েও তো  নৃসিংহের রাগ কমেনি। হিরণ্যকশিপুর সভায় যারা ছিল তাদেরকেও মেরে ফেলল, তাতেও ক্ষান্ত হলেন না, তখন দেবতারা ব্রহ্মার কাছে ছুটলেন, কী হবে। ব্রহ্মা তাঁদের মহাদেবের কাছে পাঠালেন। মহাদেব প্রথমে তাঁর ক্লোন বীরভদ্রকে পাঠালেন, কিন্তু বীরভদ্রও ফেল। তখন বাবা ভোলানাথ শরভেশ্বরের  রূপ ধরে নৃসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ-টুদ্ধ করে তাঁকে শান্ত করলেন। এই শরভেশ্বর বা শরভ রূপ হচ্ছে আরেকটা হাইব্রিড প্রাণির কল্পনা।  সেখানে মানুষ, সিংহের সঙ্গে ঈগলকেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।  তার মানে ওই স্ফিংসের মতোই ডানাওয়ালা।  মানুষ পশু এবং পাখির ফিউসনে তার শক্তি আরো বেড়ে গেছে।  নৃসিংহকে শান্ত করার জন্যে এক ডানাওলা নৃসিংহ, কী অদ্ভূত কল্পনা, তাই না! এদিকে পৌরাণিক এই কাকেশ্বর কুচকুচের গল্প শুনে আমার অবস্থাও তখন হযবরল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (২)

বাংলা কবিতায় ব্রাহ্মণ্যবাদ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১১)

একটি অনুরোধ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১২)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৫)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৮)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৫)