কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৫)
কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৫)
অতিমারীর কারণ দেখিয়ে এবছর মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হয়নি; সম্প্রতি তার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, দেখা যাচ্ছে মাধ্যমিকে পাশের হার একশো শতাংশ, যা এক ইতিহাস। তাই নিয়ে সোশাল-মিডিয়ায় জোরদার আলোচনা চলছে, অনেকেই মত প্রকাশ করে বলছেন যেমন করেই হোক পরীক্ষাটা নেওয়াই যেত। পরীক্ষা নেওয়া যেত কিনা এটা নিয়ে আর বিতর্ক করে লাভ নেই। তার সময় পেরিয়ে গেছে। তবে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর গলাতেই একটা আক্ষেপের সুর শোনা যাচ্ছে, যে প্রশ্নটা তাদের মাথায় ঘুর-ঘুর করছে তা হল আগামী দিনে স্কুল-কলেজে ভর্তির বেলায়, কিংবা কোনো চাকরি পেতে এ বছরের মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিকে পাওয়া নম্বরকে আদৌ গুরুত্ব দেওয়া হবে কিনা। স্বাভাবিক কারণেই আদের আশঙ্কা বিনা পরীক্ষায় পাশের এই মার্কশিটকে একটা বোঝার মতো তাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে নিজেদের স্কুল-জীবনের কথা। সেটা ১৯৭০-৭১ সাল। পশ্চিম-বাংলার ইতিহাসে সে এক উত্তাল সময়। রাজ্যের দিকে দিকে তখন নকশাল আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। যাদবপুর প্রেসিডেন্সি সমেত রাজ্যের অনেক নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কত মেধাবি পড়ুয়া সমাজ-বিপ্লবের স্বপ্নে দীক্ষিত হয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে রাইফেল কাঁধে ছড়িয়ে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ-বাঁকুড়া-বীরভূম-পুরুলিয়া-মেদিনীপুরের মতো জেলাগুলোর প্রত্যন্ত গ্রামের বনে-জঙ্গলে, মাঠে-ময়দানে। মেহনতি মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে বেছে নিচ্ছে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ। নানান স্কুল-কলেজে চলছে তুমুল ছাত্র-বিক্ষোভ। সারা রাজ্যে সে এক অরাজক অবস্থা। পড়াশোনা বন্ধ। আমাদের মতো এক অজ পাড়াগাঁর ইস্কুলেও সেই উত্তাপের আঁচ। ছাত্রদের দাবি পরীক্ষা দেব না। আমাদের স্কুলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ হেডস্যারকেও সেই দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে। সে বছর নিচু ক্লাসের সকলেই বিনা পরীক্ষায় পাশ। আর যারা উচ্চমাধ্যমিক বা কলেজের পরীক্ষা দিয়েছিল সেখানেও টোকাটুকি চলেছিল অবাধে। সেবারেই বাজারে প্রথম চালু হয় ‘গণটোকাটুকি’ শব্দটা। ওই সময়ে যারা উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ন হয়েছিল তাদেরও গায়ে গণটোকাটুকি করে পাশের একটা লেবেল সাঁটা হয়ে গিয়েছিল। তারপর ১৯৭২ সালে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। অবাধ রিগিং। সিদ্ধার্থ রায়ের কুখ্যাত জমানা। পরের বছরগুলোতে কংগ্রেসের অপশাসন। সে-কংগ্রেস অবশ্য ভারতের স্বাধীনতা-যুদ্ধে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করা কংগ্রেস নয়। সে-কংগ্রেস ধর্মের ভিত্তিতে খণ্ডিত একটা স্বাধীন ও স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া হতভাগ্য দেশের শাসক-দল, যাদের আচার-আচরণ ঔপনিবেশিক-শাসকের মতোই। রাজ্যে তখন এমএলএ কোটায় পিছনের দরজা দিয়ে ভাগ্যবাদের দখলে হাজার হাজার সরকারি চাকরি। সারা দেশে কুৎসিত জরুরি অবস্থা। গণতন্ত্রের কালোদিন। বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই। কেন্দ্রে জনতা-রাজ প্রতিষ্ঠা, মানুষ প্রমাণ করল কংগ্রেসকেও হারানো যায়। রাজ্যে শুরু হল বামফ্রন্টের শাসন। সে-সবও তো এখন ইতিহাস। সুতরাং শিক্ষায় অরাজকতা, ছাত্র-ছাত্রীদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া এটা কংগ্রেসের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আজকের প্রজন্ম হয়ত তার খবর রাখে না, কিন্তু আমরা সেই উত্তাপে যাদের কৈশোর ও যৌবন কেটেছে, তাদের মাথার মধ্যে এখনও ঘুর-ঘুর করে স্বপ্ন ও শিহরণের সেই-সব আগুন-রাঙা দিনের কথা।
মন্তব্যসমূহ