কে যেন ঘুর ঘুর করে (২)
কে যেন ঘুর ঘুর করে (২)
মুরারি
সিংহ
দিবাস্বপ্ন বেয়ে
অফিসের সামনের টেবিলে এসে বসে সে-যে বলে গেল,
‘স্যার, আজকাল মাথার মধ্যে কী যেন ঘুর ঘুর করে’, তাকে ঠিক চিনতে পারি না। মুখটা
ভালো করে দেখবার আগেই সে মিলিয়ে যায়। কিন্তু, তার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নটা আমার মাথায় ভিতর
ঘুর ঘুর করতে থাকে। চটকা ভেঙে জেগে ওঠার পরেও। তাইতো, কী ঘুর ঘুর করে মাথার ভিতর?
কে ঘুর ঘুর করে? আমিও ভাবতে থাকি। লকডাউনের কঠিন দুঃসময়ে কত কাছের মানুষকে
হারালাম। তাদের মধ্যে দুই অতি ঘনিষ্ঠ আত্মজন নাসের ও গৌরাঙ্গ; তাদের স্মৃতি তো
বারে বারে ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। সেই সব আনন্দের মুহূর্ত, তারা সব সময় মাথার ভিতর
ঘুর ঘুর করে। তবু অসুস্থতার প্রথম-পর্বে নাসেরকে একবার দেখতে ছূটে গিয়েছিলাম কলকাতার
মেডিকাতে। গৌরাঙ্গর বেলাত সেটাও পারিনি। আমি এখন দেশের বাড়িতে; কতকাল কলকাতা ছাড়া,
কবে ফিরতে পারব জানি না; আদৌ ফেরা হবে কিনা তাও ভবিষ্যতের গর্ভে। এখন গ্রামের
বাড়িতেই থাকি; বড়ো একা একা দিন কাটে। সারাদিন শুয়ে বসে সময় কাটাতে কাটাতে হাতে-পায়ে
খাল ধরে যায়; সকালে সন্ধ্যায় খানিক হাঁটতে বেরোই, গ্রামের রাস্তায়। কতদিনের পরিচিত
পথ, কতদিনের চেনা-জানা উদার আকাশ-পুকুর-দিঘি-দিগন্ত-মাঠ। তবু প্রতিদিন আবার তাদের নতুন করে দেখি,
নতুন করে চিনি। ছায়া রোদ মেঘ আকাশ। কত রঙের খেলা, কত রূপ পরিবর্তন। নতুন করে দেখি আর
রোমাঞ্চিত হই, আনন্দিত হই। এই প্রকৃতি এই পরিবেশ, যেন আমার রক্তে-মজ্জায় মিশে আছে।
সেই টানেই ছত্রিশ বছর বাইরে কাটানোর পরে আবার গ্রামে ফিরে আসা। আমার সমসাময়িক
লোকজন এখন সকলেই বয়স্ক, কেউ কেউ গত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগকেই
চিনি না। বাবা-ঠাকুরদার নাম বললে চিনতে পারি। বহুদিনের একটা শখ ফোটোগ্রাফি করা।
ইদানীং সেটাই বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। গ্রামের পথ-ঘাট-মাঠের ফটো তুলি। গ্রামীণ
মানুষজনের। এতদিন মোবাইলে ক্লিক করতাম, এখন পুত্র একটা ডিএসএলার কিনে দিয়েছে। সেটাতেই
শাটার টিপি। ইচ্ছে মতো। নিজের মনে। ফেসবুকে পোস্ট করি। গ্রামীণ জীবনের ছবি। আহামরি
কিছু নয়। কিছুই নতুনত্ব নেই। তবু, বন্ধুদের কারো কারো সে-সব ভালো লাগে। উৎসাহ পাই।
কিছুটা সময় ভালো কাটে। তারপর আবার সেই একঘেয়েমি ও আলস্য। তখন মাথার মধ্যে আবার সেই
‘কী যেন ঘুর ঘুর করে’। তখনই মনে পড়ে যায় জীবনানন্দের কথা। ‘আলো-অন্ধকারে
যাই—মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;/ স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,…’; হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা, আমার স্বপ্নে-দেখা ছায়ামূর্তিটার
মাথার ভিতরেও কি ‘রূপসী বাংলা’-র কবির এই ‘বোধ’-ই ঘুর ঘুর করেছিল?
মন্তব্যসমূহ