বাংলা কবিতায় ব্রাহ্মণ্যবাদ
বাংলা কবিতায় ব্রাহ্মণ্যবাদ
মুরারি সিংহ
একটা কথা, যেটা এখন আমার খুব মনে হচ্ছে, কোনো
রাখ-ঢাক না করে সেটা খুব স্পষ্ট করে বলা দরকার; বলছি, আজকে আমরা যাকে মূলধারার
বাংলা কবিতা বলে জানি তা এখনো ব্রাহ্মণ্যবাদের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে
পারেনি।
জানি, এখানে ব্রাহ্মণ্যবাদ শব্দটার প্রয়োগ
দেখে অনেকের চোখ কপালে উঠতে পারে। তাঁরা প্রশ্ন করতে পারেন ব্রাহ্মণ্যবাদ বলে আমরা
যাকে বুঝি, সে তো এক বিশেষ ধর্মীয়-সমাজের
সঙ্গে যুক্ত; বাংলা- কবিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায়। মজাটা এখানেই। আসলে কবিতায় ব্রাহ্মণ্যবাদ বলতে আমি যা বোঝাতে চাইছি,
সেটাকে এক কথায় বলা যায়, এক ধরণের বিশেষ মানসিকতা। একটা সংস্কার। সেই মানসিকতা বা
সংস্কারের অন্যতম লক্ষণ পরম নিষ্ঠার সঙ্গে কবিতায় তথাকথিত শুদ্ধতা ও পবিত্রতা
রক্ষার প্রতি অবিচল থাকা। সেই সঙ্গে এটাও দেখা, কবিতার ছন্দ-প্রকরণ-ভাষা বা
শব্দ-প্রয়োগ কোনোকিছুতেই যেন কোনো উদ্দেশ্যমূলক ভাব না থাকে। যেন কোনো হইচই,
চিৎকার বা গলাবাজি ঢুকে না পড়ে। কবিতা যেন হয় এক চিরায়ত বোধের নির্যাস। অর্থাৎ কবিতা হবে কবির নিজস্ব মন্ত্রোচ্চারণ
এবং ব্যক্তিগত আরাধনা। বেশির ভাগ কবির মনে এই বাসনাই লালিত হয়।
মাপ করবেন বন্ধুরা, এই রকম ধারণার মধ্যে
যে কোনো রকম দোষ বা অন্যায় আছে সে-কথা বলার স্পর্ধা আমার নেই। কারণ এই বোধ থেকেই
অনেক বড়ো বড়ো কবি বিস্তর বিখ্যাত কবিতা লিখেছেন এবং কবি হিসেবে প্রচুর যশ ও
হাততালি পেয়েছেন, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। আমার যেটা বলার, এই যে শুদ্ধতার প্রতি
দায়বদ্ধ থাকার চিরকেলে গোঁড়ামি, এটাই তো ব্রাহ্মণ্যবাদ। অবশ্য তাকে মোল্লাবাদও বলা
যেতে পারে। কিন্তু যেহেতু এদেশে
ব্রাহ্মণ্যবাদ গোড়া থেকেই বর্তমান সে তুলনায় মোল্লাবাদ অনেক পরে এসেছে, তাই এই
লেখায় ব্রাহ্মণ্যবাদ শব্দটাকেই বেছে নিয়েছি। সেটা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যতটা আছে, বাঙালি মুসলিমদের
মধ্যেও তার চেয়ে কিছু কম নেই। হিন্দুদের
পুজোপাঠে যেমন এখনো সমস্ত মন্ত্রই উচ্চারিত হয় সংস্কৃতে, মুসলিমদের আজান বা নমাজেও
তেমনি আরবির আধিপত্য; কোনো জায়গাতেই বাংলার কোনো প্রবেশাধিকার নেই। কারণ বিশুদ্ধতাবাদীদের বিশ্বাস এইসব আধ্যাত্মিক
অনুভূতি বাংলায় অনুবাদ করলে তা আরাধ্য ঈশ্বর বা আল্লার কাছে পৌঁছবে না, কারণ সেই
সর্বশক্তিমানেরা তো বাংলা বোঝেন না। তাই
হিন্দুদের বা মুসলিমদের মূল-শাস্ত্র বাংলায় অনুবাদ করাটাকে এক সময় পাপ বলে গণ্য
করা হত। সেই বিশ্বাস থেকেই দীর্ঘদিন বেদ
বা কোরান বাংলায় অনূদিত হয়নি, এবং যখন তাদের অনুবাদ হল, দেখা গেল, সেই অনুবাদের
কাজটি কোনো টিকিধারী-পণ্ডিত বা দাড়িওলা-মোল্লা করলেন না, করলেন কারা,
ব্রাহ্ম-সমাজের দুই তরুণ, তাঁদের একজন হলেন শ্রীরমেশ্চন্দ্র দত্ত এবং অন্যজন ভাই
গিরিশচন্দ্র সেন। সংস্কার-মুক্ত ব্রাহ্ম-সমাজ
চেয়েছিল, বাংলার মানুষেরা একে অন্যের ধর্মের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হোন।
ধর্মের পবিত্র-কাঠামোকে কখনোই অশুদ্ধ বা
অশুচি করা চলবে না, ধর্মীয় মৌলবাদের এই মূল ধারণা বা অভ্যাসটা এক সময় বাংলা-ভাষা ও
সাহিত্যের অন্দরমহলেও ঢুকে পড়েছে। আসলে সব
ধর্মের রক্ষণশীল মানুষেরা ধর্মের সর্বজনীন অনুভব বা প্রবাহমান স্রোতকে ছুঁতে না
পেরে, শুধু স্রোতের বাইরে দূষিত উপকরণ নিয়ে জমতে থাকা নানান ফেনার পুঞ্জ বা ধর্মীয়
আচার-আচরণ-রীতি-নীতি-অনুশাসনকেই ধর্ম বলে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন। কবিতায়
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অবস্থা্নটাও অনেকটা সেই রকমই। কবিতার ভাব-ভাবনা-ভাষায় একটু বিসদৃশ
বা উলটা-পালটা কিছু দেখলেই কবিতা জাহান্নামে যাচ্ছে বলে তাঁরা হল্লা জুড়ে দেন। আর
এটা তো আমরা জেনে গেছি মৌলবাদীরা চিরকালই অনুদার ও অসহিষ্ণু হোন।
শুরুতে কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম ছিল না। গোঁড়ামির
গোড়ার কথাটা এই রকম, যাঁরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে চর্চা-আলোচনা করেন তাঁরা জানেন, বাংলা ভাষা ভদ্রলোকেদের
ড্রয়িং-রুমে বসে মার্জিত-রুচির মানুষের দিয়ে তৈরি হয়নি, তা গড়ে উঠেছিল গ্রামীণ
জনপদে তথাকথিত ছোটোলোকেদের মুখে মুখে। আড়ষ্ট জিভের অশুদ্ধ উচ্চারণে। কারণ সেই সময়ে,
যখন দেশের বাকি অংশ ব্রাহ্মণ্য-সমাজের শাসন প্রবল, তখনো গোটা-বাংলা জুড়েই ছিল
ছোটোলোকেদের রাজত্ব। কারণ তখনো এখানে
সেন-রাজত্ব শুরু হয়নি এবং মনুবাদীরাও জাঁকিয়ে বসতে পারেননি; সেদিক দিয়ে ভারতবর্ষের
এক কোণে পড়ে থাকা এই অঞ্চলের মানুষ চিরকালই একটু ব্যাঁকা-ট্যারা। আদি -বাংলায় সমাজে যে সামান্য কিছু শিষ্টজন
ছিলেন তাঁদের কথ্যভাষা ছিল প্রাকৃত এবং
সাহিত্য-চর্চার ভাষা ছিল সংস্কৃত বা কখনো কখনো প্রাকৃত , এই সময়ের দুটি
উল্লেখযোগ্য কাব্য-সংকলন—সদুক্তিকর্ণামৃত ও প্রাকৃত-পৈঙ্গল। সমাজের নীচের মহলের অশিষ্ট বা বিকৃত উচ্চারণে
সেই ভাষাই তখন রূপ নিয়েছিল অপভ্রংশে। সেই
অপভ্রংশ থেকেই সৃষ্টি হল প্রত্ন-বাংলা, যার সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। বৌদ্ধ-সিদ্ধাই যোগীদের ছোঁয়া পেয়ে বঙ্গভূমি তখন
একটু একটু করে বৌদ্ধ-বাংলা হয়ে উঠেছে।
নিজেদের গোপন সাধনাকে আম-জনতার মধ্যে প্রচারের জন্যে সেই চর্যা-পদকর্তারা,
সংস্কৃত ও প্রাকৃতকে বর্জন করে সমসাময়িক লোকসমাজের মুখের আকাঁড়া ভাষাকেই বেছে
নিয়েছিলেন। তখনকার সেই অমঙ্গলের কাজটাই
কিন্তু বাঙালি ও বাংলা ভাষার জন্য মঙ্গলজনক হয়েছিল।
পাল-বংশের পরে সেন-রাজারা বাংলায় ক্ষমতাসীন
হবার পরে রাজসভার ভাষা হল সংস্কৃত। সংস্কৃতেই লেখা হল ‘গীতগোবিন্দ’। রাজ-দরবারে জনগণের মুখের ভাষা বাংলা রয়ে গেল
অচ্ছুত। আবার যখন তুর্কি-শাসন শুরু হল, তখন বহিরাগত বিধর্মীদের চাপে নবগঠিত
ব্রাহ্মণ্য-সমাজ তার কৌলিন্যকে আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রেখে, নীচুতলার সমাজের সঙ্গে
সমঝোতা করতে বাধ্য হল, বাংলা ভাষাকেও একটু একটু করে ব্রাহ্মণায়িত করতে শুরু করে দিল।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিস্তার শুরু হল ব্রাহ্মণ্য- উপনিবেশবাদের। এই পর্বে পরের
দুশো বছরে বাংলা-সাহিত্যের নিদর্শন এখনো পাওয়া যায়নি। চর্যাপদের পরে যখন
‘শ্রীকৃষঙ্কীর্তন’-এর দেখা মিলল তখন দেখা গেল বাংলা ভাষা অনেকটাই সুগঠিত হয়েছে,
এবং নাগরিক-চেতনায় আচ্ছন্ন বাংলা-সাহিত্যের ইতিহাসকাররা দেখলেন
‘আহ্মে’-‘তোহ্মে’-মার্কা সেই ভাষার সারা গায়ে তখনো গ্রাম্যতার গন্ধ লেগে আছে। পরে যত দিন গেল পদাবলি-সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য,
অনুবাদ-সাহিত্য ইত্যাদির পাতায় যতটা সম্ভব সেই গ্রাম্যতার গন্ধ কাটিয়ে ভাষাকে
ব্রাহ্মণ্য-শাসিত সমাজের উপযোগী করার চেষ্টা চলল। অবশেষে ভারতচন্দ্রের হাতে পড়ে তা
অনেকটাই দরবারি ভাষায় পরিণত হল। যদিও বাংলা-ভাষা কোনোকালেই রাজ-দরবারের দাক্ষিণ্য
লাভ করেনি। ইসলামি শাসন-কালে রাজভাষার মর্যাদা ছিল ফারসির। প্রমথ চৌধুরীর কথায় তা
ছিল ‘পলান্নের ভাষা’, আর বাংলা ছিল ‘শাকান্নের ভাষা’। অবশ্য ভাষা-প্রবাহের সাধারণ
নিয়মেই তৎসম শব্দের সঙ্গে বাংলা শব্দ-ভাণ্ডারে প্রচুর পরিমাণে তদ্ভব দেশি বিদেশি
শব্দও জমা হয়েছে। ভারতচন্দ্র নিজেই জানিয়ে
দিয়েছেন—“না রবে প্রাসাদ গুণ না হবে রসাল / অতএব কহি ভাষা যাবনি মিশাল'।
এরপর এল ছাপাখানার যুগ। বঙ্কিম, হুতোম,
আলাল। আমরা বঙ্কিমের ভাষাকে মেনে নিলাম
সাধুভাষা হিসেবে, হুতোমকে বর্জন করলাম।, আলালকে কিছুটা পরিশোধিত করে বহাল হল চলিত-বাংলা।
তবে সাধুই বলি আর চলিতই বলি, বাংলা-সাহিত্যের ভাষা হয়ে গেল ভাগীরথীর পুব-দিক তথা
হালিশহর-নবদ্বীপ-কলকাতা এই অঞ্চলের মানুষের কথ্য-ভাষা বা স্ট্যান্ডার্ড কলোকয়েল,
যা আসলে শিষ্ট তথা এলিট-সমাজের ভাষা বা দরবারি ভাষা। সে-ভাষার সারা শরীরে
ব্রাহ্মণ্য-সংস্কারের ছোঁয়া। বাংলার নানান
অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ল। ফলে প্রান্তিক-বাংলার ছেলেমেয়েদেরকে
স্কুল-কলেজে নতুন করে বাংলা-ভাষাটা শিখতে হল, কারণ বাড়িতে তারা যে-মাতৃভাষায় কথা
বলে তার সঙ্গে এই বিদ্যায়তনিক ভাষার বিস্তর ফারাক।
এখন সেই সময় থেকেই যে সব ছেলেমেয়ে
বাংলা-সাহিত্য চর্চায় আগ্রহী হইয়েছেন বা এখনো হচ্ছেন , নিজেদের অজান্তেই তাঁদের মন
ও মননে সেই ব্রাহ্মণ্য-সংস্কারই সংসার পেতে বসে আছে। হাজার চেষ্টাতেও সেই রক্ষণশীলতা থেকে নিজের চিন্তা-ভাবনা বা
লেখনিকে মুক্ত করা মুশকিল। আসলে মানুষ এক
সংস্কারবদ্ধ জীব। ছোটো থেকে বড়ো হবার পথে
নানান সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আমাদের চেতন ও অবচেতনে গেঁথে যায় বা গেঁথে দেওয়া
হয়। তার সঙ্গে যোগ হয় সিলেবাস-কেন্দ্রিক শিক্ষার নানান সংস্কার। এটাই হল ব্রাহ্মণ্য-আধিপত্যবাদের গোড়ার কথা।
সংস্কার থাকা মানেই যে সেটা খারাপ, তা
বলছি না। একটা শৃঙ্খলা-পরায়ণ সমাজ তৈরি করতে এই-রকম আচার-বিচার-সংস্কার-অনুশাসন
হয়ত জরুরি। অনেক সংস্কারের ভালো দিক যেমন আছে, তেমনি অনেক সংস্কারে নেতিবাচক
ব্যাপার-স্যাপারও কিছু কম নেই। সব চেয়ে
খারাপ যেটা, তা হল, এইসব সংস্কার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের সাধারণ চিন্তা-ভাবনায়
লাগাম পরায় বা মগজে কারফু জারি করে। চিন্তা-চেতনা ও আচার-ব্যবহারকে একটা নির্দিষ্ট
দিশায় পরিচালিত করে। ফলে মুক্ত-চিন্তার পথ অবরুদ্ধ হয়। প্রথা ভাঙতে না-চাওয়া,
গতানুগতিকতাকে মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়া, ছোটোবেলার থেকে বড়োদের শিখিয়ে দেওয়া
(অথবা চাপিয়ে দেওয়া) এই রকম সব অভ্যাসই
আমরা রপ্ত করি। তবে সব ব্যাপারেরই কিছু ব্যতিক্রমী
মানুষ অবশ্যই থাকেন, যাঁরা অনেক কুপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাঁরাই নতুন সময়ে নতুন সমাজের পথ-প্রদর্শক
হিসেবে চিহ্নিত হন।
গড্ডলিকা-প্রবাহের মধ্যে এই ব্যতিক্রমটাই
ইতিবাচক । জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালি-জনগণের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার জিনে লিখিত হয়ে
আছে, তা হল, প্রথাগত ও গতানুগতিক ব্যবস্থাগুলোকে মানতে না চাওয়া, এই বন্যতা। সেই পরম্পরাতেই শ্রীচৈতন্যদেব, লালন, রামমোহন,
বিদ্যাসাগর, শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ থেকে একান্নর ভাষা-আন্দোলন এবং
স্বাধীন বাংলাদেশ। আধিপত্যবাদ ও দখলদারের
পোষ-না-মানার এই স্বভাব বাঙালি আজো বজায় রেখে চলেছে। ক্ষেত্র ও অবস্থা-বিশেষে তা
প্রকাশিত হয়।
এবার আসি ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনায়। এখানে কিন্তু বহুকাল আগে থেকেই চর্চাটা
দুটো-ধারায় ভাগ হয়ে গেছে। একটা অভিজাত বা এলিট-সমাজের সাহিত্য-সংস্কৃতি যা নিয়ে
বাঙালির অহংকার ও গর্বের শেষ নেই; অন্যদিকে রয়ে গেছে প্রান্তিক-সমাজে আবহমান
লোকসংস্কৃতির ধারা, যেখানে আছে বাঙালির প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি;
অথচ তা কখনোই মূলধারা বলে বিবেচিত হয় না।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, বাংলা ভাষায়
বর্তমানে যা মূলধারার সাহিত্য-চর্চা বলে পরিচিত তা পুরোপুরি এলিট-সমাজের নিয়ন্ত্রণে
এবং এলিট-সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রান্তবাসী জনগণের মধ্যে তা এখনো পৌঁছতে পারেনি
বা পৌঁছতে দেওয়া হয়নি। কারণ এইসব প্রান্তবাসী জনগণের মন, যা এক কালের বাংলা-কবিতার
আঁতুড়-ঘর, তা এখনো ঝুঁকে আছে নানা রকম নাচ-গান-গল্প-নাটকীয়তা এবং রঙ্গ-তামাশা-হেঁয়ালিতে-ভরা
কবিগান-পাঁচালির দিকে। অর্থাৎ তাঁরা কবিতা
বলতে এখনো সেই রকম জিনিসকেই বোঝেন, যাকে আজকের ভাষায় বলা হচ্ছে পারফর্মিং
আর্ট। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাস বলে, মাইকেল
মধুসূদন দত্তের সময় থেকেই বাংলা কবিতা সেই পথ থেকে সরে এসেছে। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে সাধারণ মানুষের যেমন কিছু
যায়-আসেনি, তেমনি নতুন ঘরানার বাংলা-কবিতার চর্চায় কোনো ভাটা পড়েনি।
নাগরিকতার সিংহাসনে বসেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর
অসাধারণ স্বজ্ঞা দিয়ে বাংলা-কবিতাকে সহজ-পথে নিয়ে
গিয়ে পৌঁছে দিতে চাইলেন ‘ও-পাড়ার প্রাঙ্গনের ধারে’। পরবর্তী প্রজন্মের কাছ
থেকে তিনি আশা করলেন সেই প্রিয় কবির উচ্চারণ, ‘যে-আছে মাটির কাছাকাছি’। কিন্তু
রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা-কবিতায় নতুন সময়ের কবিরা আক্রান্ত হলেন চূড়ান্ত
নাগরিক-মানসিকতায়। যৌবনের স্পর্ধায় তাঁরা অস্বীকার করতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথকে এবং
নিজেদের লেখালিখিকে রবীন্দ্র-প্রভাবের বাইরে রাখতে গিয়ে তাঁরা দীক্ষিত হলেন বিদেশের মাটিতে
জন্ম নেওয়া ইউরোপীয় আধুনিকতার। এই কবিদের বেশিরভাগ ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ, তার
প্রভাব এসে গেল তাঁদের লেখালিখিতেও। ইংরেজদের মানসিকতার মূলে আবার সে-দেশের সুট-বুট-পরা
ব্রাহ্মণ্যবাদ, যা আপাদমস্তক আরো রক্ষণশীল। তাই খুব নীরবে ব্রিটিশ উপনিবেশেরবাদের ডিভাইড-এন্ড-রুল,
হোয়াইট-এন্ড-নেটিভ, অ্যাপারথেড ইত্যাদির সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য-উপনিবেশবাদের উঁচুজাত-নিচুজাত,
ভদ্রলোক-ছোটোলোক, অস্পৃশ্যতা এইসব ন্যারেটিভের সুন্দর মিলমিশ হয়ে গেল। ফলে
সাহিত্যের ভাষা ও প্রকরণের দিক দিয়ে আধুনিক কবিরাও হলেন চরম রক্ষণশীল। আধুনিকতা
আসার পরে বাংলা-কবিতার সামনে বিশ্ব-কবিতার
ধারাকে জানার ও চেনার একটা নতুন দিগন্ত
উন্মোচিত হল ঠিকই, কিন্তু বাংলা-কবিতা হয়ে গেল ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে পড়া এবং গরমের
দেশে কোট-টাই পরা ঝকঝকে ও স্মার্ট, যার সঙ্গে দেশের মাটির সম্পর্ক হল ক্ষীণ।
কবিতার শরীরে আধুনিকরা যে সুর-তাল-লয় ও
ছন্দ গেঁথে দিলেন সেই তালেই এগিয়ে চলল বাংলা-কবিতার পরবর্তী ধারা। নতুন প্রজন্মের অনেকেই অবশ্য সেই ধারায় অনেক
নতুন মাত্রা যোগ করলেন, তাতে করে অনেক নতুন উচ্চারণও শোনা গেল, কিন্তু কবিদের
মধ্যে শব্দ-চয়নের ব্যাপারে মূল ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতার খুব একটা হেরফের হল না। তাঁদের কবিতায় দেখা গেল তৎসম-শব্দের বাহুল্য, অনেকেই
হলেন অভিধান-নির্ভর, ব্যবহার করলেন বিদেশি মিথ, বিদেশি চিহ্ন-রূপক ও চিত্রকল্পকে;
কিছু পরে অনেকেই আবার স্বীকারোক্তি-মূলক কবিতা লিখে ব্যক্তিগত পাপস্খালনের দিকে মন
দিলেন (চার্চের কনফেসন-বক্সের আদলে) , কবিতার ভঙ্গি ও ভাষায় কেউ আনতে চাইলেন
বোহেমিয়ান ভাব, আবার কেউ কেউ একটা হ্যাঁচকা টান মেরে ভদ্রবাবুদের গড়ে তোলা বাংলা
কবিতার তথাকথিত সতীত্ব নষ্ট করতে চাইলেন, কিন্তু তাঁদের অশুদ্ধতা মানে শুধুই
অশ্লীলতার নানা কিসিম, যেগুলো ইউরোপীয় আধুনিকতারই গলিত ও বিকৃত এঁটোকাঁটা। এই সব মানসিকতার
মধ্যেও হতাশা-বিদ্ধ বিক্ষুব্ধ ও ক্রুব্ধ নাগরিকতার লক্ষণগুলোই স্পষ্ট হল। ইঁট-কাঠ-পাথরের
শহুরেয়ানার মধ্যেই তা ঘুরপাক খেল, কেন্দ্রীয়-চেতনার গণ্ডি ভেঙে অপর-বাংলার
মুক্ত-পরিসরে বেরিয়ে আসার কোনো সচেতন চেষ্টাই তাঁদের ছিল না।
বিংশ শতকের শেষে আধুনিক-পরবর্তী সময়ে এসে
মানুষের চিন্তা-ভাবনায় এক আমূল পরিবর্তন এল।
কেন্দ্রিকতার বিলুপ্তি ঘটিয়ে গুরুত্ব বাড়ল প্রান্তিকের। এল বিনির্মাণের
ধারণা, বহুস্বর ও বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, অনির্ণেয়তা, ইন্টারটেক্সটুয়ালিটি,
জটিলতা এইসব নতুন-নতুন ধ্যান-ধারনা। এই
সময়কে চিহ্নিত করা হল পোস্টমডার্ন কালখণ্ড হিসেবে। ইতিমধ্যে বাংলা-কবিতাতেও যে
নতুন প্রবণতা দেখা গেল তা হল নগরকেন্দ্রিকতার বাইরে গ্রাম-গঞ্জ-মফস্সল থেকে অজস্র
নতুন ছেলেমেয়ে কবিতা লিখতে আসছেন। ফলে কবিতার পরিসর অনেক বেড়ে গেছে, তার সুর ও স্বর বদলেছে; তার উপর উচ্চ-প্রযুক্তি,
বিশ্বায়ন ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে ভারত, বাংলাদেশ, ইউরোপ-আমেরিকা বিশ্বের
বাঙালিরা এখন একই ছাতার তলায় চলে এসেছেন।
সোশালমিডিয়া থেকে প্রত্যেকেই জানতে
পারছে কোথায় কী ধরণের লেখালিখি-চর্চা-আলোচনা চলছে। আধুনিক সময়ে যাঁরা বড়ো হয়েছেন তাঁরা এই সুযোগ-সুবিধে
পাননি। এখন অজস্র সম্ভাবনার দরজা খুলে গেছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যাঁরা প্রান্তিক
থেকে উঠে আসছেন তাঁরাও কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে সেই কেন্দ্র তথা সাজানো-গোছানো নাগরিক
ভাবনাকেই অনুসরণ ও অনুকরণ করছেন। ফলে এখন
যে গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতায় ভরে যাচ্ছে চারপাশ তা আসলে হয়ে উঠছে মাস-পোয়েট্রি বা ভিড়ের
কবিতা। সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রন্তিকের
নিজস্ব অনুভূতি বা প্রন্তিকের চোখে দেখা প্রান্তিক
উপাদানগুলো অনুপস্থিত থাকছে। অনুপস্থিত
থাকছে লোকজ ভাব-ভাবনা-চিহ্ন-চিত্রকল্প। নতুনদের লেখাতেও গুরুত্ব পাচ্ছে নাগরিক
উচ্চারণ এবং অজস্র সাধু ও তৎসম শব্দের ব্যবহার।
বোঝা যাচ্ছে, নতুন শতকের কবিরাও ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতার নীরব আগ্রাসন
থেকে নিজেদের মুক্ত করার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। তাদের মনেও গোপনে কাজ করে চলেছে জাতে-ওঠার
প্রবণতা।
আরো একটা প্রবণতা নজরে না পড়ে পারে না, কবিতার আলোচনা-সমালোচনার আসরে অনেকেই
নীতি-পুলিশ হতে চাইছে, বিচারক সাজতে চাইছে; সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তি-আক্রমণ, কেচ্ছা
করা, কাদা-ছোড়াছুড়ি –এসবও এখন আকছার। যে-কোনো আক্রমণের পিছনেই ক্ষমতা বা আধিপত্য
জাহির করার চেষ্টা থাকে, অপরকে খাটো করে নিজেকে বড়ো করার মানসিকতা থাকে, একটা
আগ্রাসী মনোভাব থাকে; যার শেকড়ে রয়ে গেছে
সেই আগ্রাসন তথা মৌলবাদের পুষ্টি। তারপর ভাবুন, এত যে আমরা-ওরা ভেদাভেদ; আমরা
ভদ্রলোক ওরা ছোটোলোক, আমরা জেনারেল ওরা
সিডিউল, আমরা ফর্সা ওরা কালো, আমরা লম্বা ওরা বেঁটে, আমরা শহুরে ওরা গেঁয়ো, আমরা
শিক্ষিত ওরা মূর্খ, আমরা বুদ্ধিমান ওরা বোকা (অথবা আমরা উচ্চমেধা ওরা
মধ্যমেধা/নিম্নমেধা), আমরা অধ্যাপক ওরা পাতি-ইস্কুলমাস্টার, আমরা হিন্দু ওরা
মুসলমান (অথবা উলটো-ভাবে, আমরা মুসলমান ওরা হিন্দু), আমরা এই-পার্টি ওরা ওই-পার্টি,
আমরা পুরুষ ওরা নারী, এই রকম আরো অনেক চিৎকার –এসব মনোভাবও আসলে দীর্ঘকাল ধরে আমাদের
ঘাড়ে চেপে বসা ব্রাহ্মণ্য-সংস্কারের ভূত-পেত্নি । আমরা কখনো ভেবে দেখি না, এমন ধরণের কথাবার্তার
মধ্যে দিয়ে মানুষকে অসম্মান করা হয়, মনুষ্যত্বকে অপমান করা হয়। এসবই ডিভাইড এনফ
রুল পলিসি। এর পিছনে আছে মনুবাদী-সমাজের মদত, রাষ্ট্রের মদত, বহুজাতিক-পুঁজি ও কর্পোরেট-সংস্কৃতির
মদত। এই মানসিকতা থেকেই আবার কারো কারো মাথার উপর চেপে বসে সব-কিছুতেই কর্তা-সাজার
বাসনা, সাহিত্য-সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার
বাসনা, রাজকবি বা সভাকবি হবার বাসনা। আবার সেই সঙ্গে সরকারি বা কোনো প্রভাবশালী গোষ্টীর প্রসাদ-লাভের বাসনা
থেকে, পুরস্কার/সম্মান লাভের বাসনা থেকে, নামী-দামি মাচায় উঠে কবিতা-পড়ার বাসনা
থেকে, সেই রাজকবি-সভাকবিদের পিছনে কবি-যশোপ্রার্থীদের লম্বা লাইন দিনে দিনে আরো লম্বা হয়ে যাচ্ছে।
এতক্ষণে পাঠক নিশ্চয় বুঝে গেছেন, কবিতায়
ব্রাহ্মণ্যবাদ বলতে আমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছি। তবু এই ধরণের মানসিকতার লোকজন বলতে
কাদের বোঝাতে চাইছি, তা আরো একবার বলি; ব্রাহ্মণ্যবাদের মূল ন্যারেটিভটা আমদের
সকলেরই খুব চেনা ও জানা। পোষ-মানানো। দাবিয়ে রাখা। বনের পাখিকে ধরে এনে খাঁচায়
বন্দি করা। অপরের আনুগত্য ও বশ্যতা আদায় করে তাদের উপর উপততলার শাসন জারি রাখা। এমন
ভাবধারার মানুষেরা খুবই সফিস্টিকেটেড পাবলিক। তাঁরা কবিতায় মার্জিত ও পরিশীলিত একটা
উঁচু-ভাব বজায় রাখতে চান। অতীন্দ্রিয় অনুভূতি চান। সুগভীর দার্শনিকতা চান। নিখুঁত
ছন্দ চান। নান্দনিকতা চান। সুন্দরের উপস্থিতি চান। তাঁরা বিশ্বাস করেন কবিতা লিখতে
গেলে উপযুক্ত শিক্ষা দীক্ষা এবং তপস্যা দরকার। তার জন্য সাধক হতে হবে। সাধকেরই আরেক নাম সাধু। অতএব কবিতার
শব্দ-ব্যবহার ছন্দ ও ব্যাকরণে সাধুতা বজায় রাখাটা খুব জরুরি। তাঁরা খুব সতর্কভাবে নজর রাখেন কবিতার আঙ্গিক ও
ভাষাকে ধুলো-মাখা পৃথিবীর কোনো মলিনতা যেন
ছুঁতে না পারে। কবিতাকে অশুচি করতে না পারে। তাঁদের মতে, কবিতার মধ্যে রোজকার আটপৌরে জীবন-যাপনের সুখ-দু;খ-আনন্দ-কষ্ট-বেদনা-বিক্ষোভ-বিদ্রোহ
এসবের প্রতিফলন আসতেই পারে, কিন্তু তা যেন কখনোই কবিতার দেহ বা মনকে কলুষিত না
করে। কবিতার স্রোতকে দূষিত করতে না পারে। তাঁরা এও বিশ্বাস করেন, কবিতার পাঠককেও
শিক্ষিত-দীক্ষিত রুচিশীল মেধাবী ও মননশীল হতে হবে। ফলে এই সময়ের কবিতাও শেষ পর্যন্ত এলিট-গ্রুপের
মুষ্টিমেয় শিক্ষিত মানুষের চর্চা ও আলোচনার বিষয় হয়েই থেকে যাচ্ছে। মাচা-বন্দি কবিতাপাঠের আসর আভিজাত্যের গণ্ডিকে
ভাঙতে পারছে না।, ভাঙার চেষ্টাও নেই। কবিতা
বা তার ভাষাকে কেউই গরিব হতে দিতে চান না।
সোশাল-মিডিয়ার মুক্ত-দরবারে দেশের নানা প্রান্ত থেকে এই যে অজস্র ছেলেমেয়ে দিন নেই
রাত নেই কবিতা পোস্ট করে চলেছে, নিতান্ত
ঠেকায় পড়া কর্তাবাবুরা এসব মেনে নিতে বাধ্য হলেও, আন্তরিকভাবে যে পছন্দ করেন না,
এসব তাঁদের কথাবার্তা ও হাবভাবেই প্রকাশ পায়। আরে-বাবা, যে-যেখান থেকে যেমন খুশি
পারুক নিজস্ব উচ্চারণের নিজের কবিতা নিজের মতো করে লিখবে ও পোস্ট করবে, এতে বড়োবাবুদের
এত আপত্তিই বা কীসের! পাঠক, একবার অনুগ্রহ
করে ভেবে দেখুন, এইসব ভাবনা-চিন্তার মধ্যেও কি রয়ে যায়নি, গভীর অবচেতনের গোপন
কুঠরিতে জমে থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদের অবশেষ? যদি
তাই হয়, আমার প্রশ্ন হল, বাংলা কবিতায় এভাবেই কি ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপট চলছে ও চলবে!
মাপ করবেন পাঠক, কাউকে আঘাত করার বা আহত
করার বাসনা থেকে নয়, আমার মনে হল বলেই, নিজের অনুভূতির কথা এভাবে নিঃসংকোচে এবং
সবিনয়ে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। যতটা সম্ভব নিজের মতো করে নিজের উপলব্ধিকে বিশ্লেষণ
ও ব্যাখ্যা করলাম। এ-ব্যাপারে ভিন্ন মতও
থাকতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক। নতুন প্রজন্ম যদি এ-ব্যাপারে আরো ভাবতে চায়, ভাবতে
পারে।
সব শেষে, পাঠক যদি জানতে চান, এসব কবিতা
কি তাহলে মাল-গুদামে ডাঁই হয়ে জমতে থাকবে এবং এক রাশ ভিড়ে হারিয়ে যাবে। আমাদের
পছন্দ হোক বা না-হোক, মাস-পোয়েট্রির সেটাই কিন্তু অনিবার্য গন্তব্য। তাতে তো হতাশার
কিছু নেই, উদ্বেগের কিছু নেই, অনুশোচনারও কিছু নেই। শুধু এই-সময়ের বলে নয়, সব কালেই
এটা হয়ে থাকে। মধ্যযুগের পদাবলি-সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ সাহিত্যের অজস্র
লেখালিখির ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। ভবিষ্যতেও তাই হবে।
তবে, এখনকার এই লেখালিখির মধ্যে যে
ইতিবাচক কিছুই নেই, এমনটাও ভাবতে বলছি না। কারণ, নতুন-প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কবিতা
লেখার পিছনে সময় দিচ্ছে, কবিতা লিখে আনন্দ পাচ্ছে, কবিতাকে উপভোগ করছে, এবং
চারপাশের এই চরম দুঃসময়ের মাঝেও কবিতা যে এখনো অনেকের কাছে আশ্রয়ের জায়গা হয়ে ওঠার
শক্তি ধরে রেখেছে, সেটাও কিন্তু কিছু কম কথা নয়। বরং সেটাই সব চেয়ে বড়ো কথা। আমার
মতো কবিতা-অনুরাগীদের কাছে সেটাই সব চেয়ে আনন্দের কথা। তুমুল উৎসাহ ও আগ্রহ না
থাকলে এত ছেলেমেয়ে কবিতা লিখতে আসবেই-বা কেন! আর কবি ও কবিতার জন্য তো সপ্ত-সিন্ধু
দশ-দিগন্ত চিরকালই খোলা আছে।
এই প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, জীবন
যেমন কোনো সময়েই কোনো হিসেব-নিকেশ মেনে চলে না, তেমনি কষ্টি-পাথরে মেজে-ঘষে শুধুই
কালোত্তীর্ণ হবে এমন ভালো ভালো কবিতা কোনোকালেই লেখা হয় না। জ্যোর্তিবিদেরা বলে
থাকেন, মহাবিশ্বের এক সুবিশাল ক্যায়স থেকেই এক একটা নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। তেমনি, এই অজস্র গণকবিতার মধ্যে থেকেই এক একটা
নবতম নক্ষত্রের জন্ম হবে।
এই বিশ্বাস ও আশা নিয়েই তো আমাদের আরো সামনের
দিকে তাকিয়ে থাকা।
এবং এগিয়ে যাওয়া।
মন্তব্যসমূহ