কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৮)
কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৮)
মুরারি সিংহ
ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ১২৯তম ‘নাসদীয় সূক্ত’-এর কথা বলছিলাম। বলছিলাম, ঋষিরা তখন সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গভীর চিন্তায় মেতে আছেন। সূক্তের পরবর্তী ঋকগুলোতে জানানো হল, সর্বপ্রথমে অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল। সব জায়গাই ছিল চিহ্ন-বর্জিত এবং চারদিক ছিল জলময়। বুঝুন, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের চিন্তায় কেমন ফাঁক তৈরি হচ্ছে; কিছুই ছিল না বলেই বলা হচ্ছে অন্ধকার ছিল এবং জল ছিল। তার মানে অন্ধকার এবং জল কি ‘কিছু’-র মধ্যে পড়ে না? যাই হোক, তারপর বলা হল, যা-কিছু-নেই তাই দিয়ে সেই সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন। তার মানে, এখানে ঋষিদের মাথায় এক সর্বব্যাপী-র ভাবনা এল। তারপর, ‘তপস্যার প্রভাবে সেই এক বস্তু জন্মিলেন’। এখানে বোঝা গেল না, যেখানে কেউ ছিল না, সেখানে তপস্যা এল কোথা থেকে এবং সেই তপস্যটা কে করে ছিল। তবে ‘সর্বব্যাপী’ যখন এসেই গেছেন, তখন অন্য সবকিছুই আসবে, সুতরাং সবকিছু তার উপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। তাহলে আর পরের ভাবনায় কোনো ঝুঁকি থাকে না। মাথার মধ্যে ঘুর-ঘুর করা কোনো প্রশ্নও থাকবে না। বলা হল, ‘সর্বপ্রথমে মনের উপর কামের আবির্ভাব হইল। তাহা হইতে সর্বপ্রথম উৎপত্তি কারণ নির্গত হইল। বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধি দ্বারা আপন আপন হৃদয়ে পর্যালোচনা-পূর্বক অবিদ্যমান বস্তুতে বিদ্যমান বস্তুর উৎপত্তি স্থান নিরূপণ করিলেন। রেতোধা পুরুষেরা উদ্ভব হইলেন। মহিমাসকল উদ্ভব হইলেন। উহাদিগের রশ্মি দুই পার্শ্বে ও নিম্নের দিকে এবং ঊর্ধ্ব দিকে রহিলেন’; এই পর্যন্ত বলে আর্য ঋষিরা বুঝতে পারলেন কথার মধ্যে আবার ফাঁক থেকে যাচ্ছে। দ্বিচারিতা হয়ে যাছে। সুতরাং আবার একটা সংশয়ের মেঘ ভাসিয়ে দেওয়া হল; বলা হল ‘কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করিবে? কোথা হইতে জন্মিল? কোথা হইতে নানা সৃষ্টি হইল? দেবতারা এই সমস্ত নানা সৃষ্টির পর হইয়াছেন। কোথা হইতে যে হইল, তাহা কেই বা জানে? এই নানা সৃষ্টি যে কোথা হইতে হইল, কেহ সৃষ্টি করিয়াছেন কি করেন নাই, তাহা তিনিই জানেন, যিনি ইহার প্রভুস্বরূপ পরমধামে আছেন’; এখানে আবার হল্ট, সবকিছু এক ‘প্রভু’ ও ‘পরমধাম’-এর উপর ছেড়ে দেবার পর আবার সেই সংশয় ফিরে এল— ‘অথবা তিনিও না জানিতে পারেন’। দেখুন, চিন্তার মাত্রা ও পরিসর কতটা এবং কেমন করে ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘অথবা তিনিও না জানিতে পারেন’; তার মানে বুঝিয়ে দেওয়া হল ‘পরমধাম’-এ থাকা ‘প্রভু’-টিও সবজান্তা নন। আমি নিশ্চিত, ঋকবেদ-সংহিতার এই ঋকগুলো পড়ার পরে যে-কোনো চিন্তাশীল পাঠকের মগজেও ঝড় বয়ে যাবে। অবশ্য যাঁরা বেদের মীমাংসার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বৈদিক ঋষিদের মধ্যে প্রথম থেকেই প্রশ্নহীন আনুগত্যের বাইরেও কিছু মানুষ থেকে গিয়েছিলেন। সে যুগে মাথা নত না করে, তাঁরা যুক্তি সাজিয়েছেন, তর্ক করেছেন, কার্য-কারণ সম্পর্ক অনুসন্ধান করেছেন। তাঁদের তোলা তর্কের মীমাংসা খুঁজতে গিয়ে তখনকার সমাজের কর্তাবাবুরা হিমসিম খেয়েছেন। যদিও সেই কৌম-সংস্কৃতির যুগে ব্যক্তি-মানুষের আলাদা কোনো অস্তিত্ব স্বীকার করার রেওয়াজ ছিল না, সবটাই ছিল গোষ্ঠী-চেতনার উপর নির্ভরশীল। তবু তখন প্রশ্ন ছিল, খোলামেলা আলোচনার জায়গা ছিল, ব্যক্তির প্রশ্নই হয়ত গোষ্ঠীর প্রশ্নে রূপান্তরিত হয়েছিল। এক সঙ্গে অনেকের মাথাতেই কী যেন ঘুর-ঘুর করেছিল। কুট-কুট করে কামড়েও ছিল। তা নাহলে এত প্রশ্নের জন্ম হবে কেমন করে? যদিও উদারনৈতিক বৈদিক-পরিবেশে দাঁড়িয়ে নাসদীয়-সূক্তে সৃষ্টি-কর্তার লিঙ্গ-নির্ধারণ করতে গিয়ে একটা পুরুষ-পুরুষ আবহ তৈরি করা হল।
মন্তব্যসমূহ