কে যেন ঘুর ঘুর করে (১২)
কে যেন ঘুর ঘুর করে (১২)
কোনো কিছু লিখতে
বসলে অনেক কিছুই মাথার মধ্যে ঘুর-ঘুর করে। সেখানে অনেক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা এসে
হাজির হয়। প্রশ্ন করে। আমাকে দিয়ে তারা অনেক কথাই ভাবিয়ে নেয়। আজ বেদের কথা লিখতে
লিখতে হঠাৎ এক নতুন ব্যাটা হাজির, সে আমাকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা
আর্যরা আসার আগেও তো এদেশের একটা নিজস্ব সভ্যতা ছিল। বললাম হ্যাঁ, তা
ছিল; হরপ্পা সভ্যাতার কথা আমরা সকলেই ইতিহাস
বইয়ে পড়েছি। সেটা আর্যদের আগের এবং আর্যদের চেয়ে অনেক উন্নত সভ্যতা। এদেশের সেই
সময়ের মানুষেরাই তা গড়ে তুলেছিল। আর্যরা তো আধা-সভ্য প্যাসটোরাল জাতি। অন্যদিকে
এদেশে তখন পুরোপুরি নাগরিক সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশ। তাও আবার নয় নয় করে দেড় হাজার
বছরের পুরোনো সেই সভ্যতা। যদিও তা তাম্রযুগের নাগরিক সভ্যতা, তবু
সে এতটাই সুপরিকল্পিত ও প্রাগ্রসর যে তার ভগ্নাবশেষ দেখে আধুনিক সময়ের বিদেশী
পণ্ডিতেরা পর্যন্ত হতবাক হয়ে গেছেন। তাকে নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন, অনেক লেখালিখি
করেছেন। মাটি খুঁড়ে খুঁজে পাওয়া স্থানগুলিতে পাকা ইঁটের তৈরি বাড়ি-ঘর, স্নানাগার,
শস্যগোলা
থেকে শুরু করে উন্নত-মানের রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ-সিস্টেম, ওজন
ও পরিমাপ এবং অন্যান্য অজস্র উপাদান দেখে আমাদেরও অবাক বিস্ময়ে হাঁ-করে তাকিয়ে
থাকতে হয়; গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসতে হয় আজ থেকে পাঁচ-হাজার বছর আগে যারা বর্তমান
ছিলেন, আমাদের সেই পূর্ব-পুরুষদের জীবনচর্চা কী করে এতটা গভীরতা ও বিস্তৃতি লাভ
করেছিল। কিন্তু আফশোষের কথা একটাই, এইসব মানুষগুলোর চিন্তা-ভাবনার কোনো
হদিশ আমাদের কাল পর্যন্ত এসে পৌঁছলো না, কারণ তাঁরা সে-সবের কোনো লিখিত বিবরণ
রেখে যাননি। অথবা বলা ভালো, তাঁদের সিলমোহরে যে-সব লিপি খোদিত আছে, তথ্য-প্রযুক্তির
এত রমরমার যুগে এসেও, আজ পর্যন্ত, আমরা তাদের
পাঠোদ্ধার করতে সমর্থ হলাম না। তবু সিন্ধু উপত্যকতার উৎখননে হরপ্পা-যুগের মানুষদের
নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে তাদের মধ্যেও অনেক বার্তা, অনেক সংকেত
লুকিয়ে আছে। অতঃপর সেসব নিয়েই ভাবনা-চিন্তা করা দরকার; এবং তা করতে হবে
আমাদের এই ঝকঝকে ডিজাইন করা সভ্যতা আমাদের মধ্যে যে চিন্তা-পদ্ধতি প্রি-ইন্সটল করে
রেখেছে, যে ভাবে প্রোগ্রামিং করে দিয়েছে, তার মধ্যে থেকেই। আমার ভাবনাবাবু বলেলেন,
ভাব,
ওই
হরপ্পা-সভ্যতার মানুষেরা যে বিশাল এলাকা জুড়ে অমন একটা নাগরিক সভ্যতা গড়ে তুলল,
তা
একদিনে হয়নি; হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর নগরগুলো রাতারাতি হঠাৎ করে
আকাশ থেকেও পড়েনি। তাদের হয়ে ওঠার পিছনে আরো অনেক হয়ে ওঠা ছিল। শুরুও একটা শুরু
ছিল। সুদীর্ঘ সময়ের হিসেব-নিকেশ ছিল। ভাবো তো দেড়-হাজার বছর ধরে মানুষগুলো যে
নাগরিক জীবনযাপন করে গেল, আজ এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে জানতে ইচ্ছে করে না, কেমন ছিল
সে জীবন, কেমন ছিল তাদের জ্ঞানগম্যি, কেমন ছিল তাদের শিল্প-শিক্ষা-সংস্কৃতি?
এতদিন ধরে তো সে-সব নিয়ে অনেক গবেষণা, অনেক লেখালিখি হয়েছে; এবার
নাহয় একটু অন্য রকম ভাবে ভাবলি; নাই বা থাকল তাদের লিখিত বিবরণ। এখন চোখ বন্ধ
করে একবার ভাব তো, সেদিনের ওই যে মাটির তৈরি অত সিল, মূর্তি,
পুতুল
সেগুলো তো আজকের একগুচ্ছের ভাঙচোরা খোলামকুচি নয়; সেগুলোর সিটি-স্ক্যান করে দেখ
তাদের ভিতরেও অনেক কথা লুকিয়ে আছে; সে-সব নিয়ে এই নতুন সময়ে নতুন করে আরো
অনেক অনেক কিছু ভাবার আছে। ভাবনাবাবুর সব কথা শুনেও আমি চুপ করে আছি দেখে, তিনি আবার
বলল, আরে ভাব ভাব, ভাবা প্র্যাকটিশ কর। চমকে উঠলাম
কথাগুলো খুব চেনা চেনা লাগছে। আগে কোথায় যেন শুনেছি; তারপরেই মনে পড়ল,
আরে
এতো ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’;
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপ, ‘ভাবো ভাবো,
ভাবা
প্র্যাকটিশ করো’।
মন্তব্যসমূহ