কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৮)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৮)

 আমাদের পুরাণের গল্পগুলো সত্যিই বড়ো অদ্ভূত। এইসব গল্প-কাহিনিতে লোকায়ত-ভাবনার কত রূপই না প্রকাশিত হয়েছে।  কিন্তু আমাদের এমনি হতভাগ্য অবস্থা আমরা তাদের মোটা দাগের ধর্মীয় আবরণে ঢেকে তাতে গদগদ ভক্তিরস উপুড় করে দিয়েছি। অন্যদিকে সেই ধর্মীয় আস্তরণের অজুহাত দেখিয়ে আমাদের সারস্বত সমাজও পৌরাণিক ব্যাপারগুলোকে অছূত করে রেখেছে। সেগুলো থেকে নিজেদের অতীতকে নতুন করে আবিষ্কারের রাস্তায় হাঁটেনি, আলাপ-আলোচনায় সেগুলো নিয়ে বিকল্প কোনো ভাবনাকে আমল দেয়নি। অথচ এদেশের লোকভাবনার বিকাশ ও বিস্তারকে জানার জন্যে এগুলো হয়ে উঠতে পারে অমূল্য আকর। আমরা ভুলে যাই, বৈদিক আর্যরা এদেশের ভূমিপুত্র-ভূমিকন্যাদের জন্য তাদের সদর দরজাতে খিল এঁটে দিলেও সমাজের খিড়কি দরজাটা কিন্তু খোলাই ছিল। সেই পথেই এদেশের কালো-কুৎসিত মানুষগুলো তাদের ধর্মভাবনা, সমাজভাবনা, সাংস্কৃতিক চিন্তা সবকিছু বগলদাবা করে শিষ্ট-সমাজের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে প্রাচীন যা-কিছু সব তছনছ করে তাকে দেশীয় ঐতিহ্যে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে।  প্রাচীন কর্তারা শুধু সবকিছুর উপর বারে বারে ব্রাহ্মণ্যমতের মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে তাদের শুদ্ধ করতে চেয়েছে।  যজ্ঞ-সর্বস্ব বৈদিক সময়ে কে আর ভেবেছিল এদেশের ঝোপ-ঝাড়-বন-জঙ্গল থেকে শিব-কালী-দুর্গা থেকে শুরু করে মনসা-শীতলার মতো দেবদেবীরা উঠে এসে ইন্দ্র-মিত্র-বরুণদের বরখাস্ত করে জনসমাজের উপাস্য দেব-দেবী হয়ে উঠবে, আর পৈতেধারী ব্রাহ্মণরা তাদের পুজো করবে, বা করতে বাধ্য হবে।  হতে পারে বিবর্তনের ধারা বেয়ে জীব-জন্তু ঘেরা হরপ্পার সেই আদি-শিবই আজকের রাঢ়-বাংলার  বুনো-শিব বা বুড়ো-শিব। আমার ভাবনাবাবু বললেন, সুকুমার রায় থেকে এবার চল চলে যাই, লালমাটির দেশে। বন-জঙ্গল ঘেরা লালমাটির দেশ বাঁকুড়া। বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ো গ্রাম। রাঢ়-বাংলার এই ছোট্ট গ্রামটার সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে  বাংলা ও বাঙালি মননের এক সমৃদ্ধ অতীত।  তুই বুঝেছিস নিশ্চয়, আমি পাঁচমুড়োর পোড়ামাটির ঘোড়ার কথা বলছি। ঘোড়া তো পৃথিবীর সব দেশেই আছে, টেরাকোটাও আছে; কিন্তু পাঁচমুড়োর টেরাকোটার ঘোড়া, সারা বিশ্বে আজ যার সমাদর, আহা, লম্বা গলা লম্বা কানঅলা সেই ঘোড়ার গড়ন যে এমন অপরূপ হতে পারে সেটা পাঁচমুড়োর শিল্পীদের আগে আর কে ভেবেছিল বল। কী লাবণ্য, কী আভিজাত্য, কী রাজকীয় ভাব।  বাঁকুড়ার ঘোড়ার ছবি ব্যবহার করেই তৈরি হয়েছে আজকের অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্র্যাফটস সংস্থার লোগো। তার মানে, শিল্প-রসিকদের কাছে তার গুরুত্ব কতটা বুঝতে পারছিস।  এরপর তুই যদি পাঁচমুড়োর ঘোড়ার পাশে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলকে রাখিস তাহলে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করবি।  কৃষ্ণনগরের  মৃৎশিল্পও খুব বিখ্যাত।  তার পরিচয়ও দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।  কিন্তু ভেবে দেখ কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল আসলে রিয়েলিস্টক আর্ট। চারপাশে যা যা দেখা য্যয় সেই মানুষ পশু পাখি সবজি ফলমূল এসবের হুবহু অনুকরণ।  যদিও খুব ছোটো আকার মানে মিনিয়েচার ফর্মে।  সেই হিসেবে এই মূর্তি তৈরি করতে খুব নিপুন কারিগরি দক্ষতা দরকার আর পাঁচমুড়োর ঘোড়ার উদ্ভাবন করতে যেটা দরকার হয়েছিল তা শুধু কারিগরি দক্ষতা নয় তার সঙ্গে আরো কিছু বেশি, যার নাম ইমাজিনেশন এবং ইনটিউশন। এই কল্পনা এবং স্বজ্ঞা কাজে লাগাতে পেরেছিল বলেই শিল্প হিসেবে তাদের কদর অন্য রকম , শিল্পীদের কাছে এটা এক ধরণের বিমূর্তায়ন বা অ্যাবস্ট্রাক্টনেস।  পশ্চিমি দেশগুলোতে এর শুরু অনেক পরে। জার্মানির এক্সপ্রেশানিস্ট আন্দোলনের সময়। এসব শিল্পের উদ্ভাবন  এক দিনে দুদিনে হয় না। অনেক দিন ধরে তা গড়ে ওঠে।  এ এক আন্তরিক উপলব্ধি। আবার এটা কোনো ব্যক্তি-বিশেষের  সৃষ্টি নয়, এর পিছনে একটা গোষ্ঠী তথা সমাজের অবদান আছে।  আমি ভাবছিলাম এই ঘোড়ার সঙ্গে যে একটা ধর্মীয় আবহ জড়িয়ে আছে তার কথা; সেটা আঁচ করেই ভাবনাবাবু বলল ধর্মীয় অনুষঙ্গ একটা আছে বটে, তবে তা কোনো তত্ত্ব, নীতিকথা বা অনুশাসনে ভারাক্রান্ত শাস্ত্র মেনে তৈরি নয়,  রাত জেগে লেখা কোনও পুঁথি নয়; এ যেন এক অন্য মনের তৈরি, শিল্পীমানসের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ। একটা অচেনা-অজানা গল্প। এক অলিখিত কবিতা। সেই গল্প বা কবিতার মধ্যে দিয়ে অনেক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক কথা বলতে চাওয়া হয়েছে। তোর এই ভাবনাবাবুর মতো তাদের মাথাতেও কত ভাবনাবাবু ঘুর-ঘুর করেছে; সেটাই এখন আমাদের আরো বেশি করে ভাবার সময় এসেছে।  


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (২)

বাংলা কবিতায় ব্রাহ্মণ্যবাদ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১১)

একটি অনুরোধ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১২)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৫)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৮)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৫)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৭)