কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৬)
কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৬)
এই গদ্যটা লেখা শুরু করার পর থেকেই প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে, কখন ভাবনাবাবু এসে দরজার কড়া ঠক্ঠক করবে। তখন দরজা না খুললে, ভাবনাবাবু গোঁসা করে ফিরে যাবেন, আমার লেখাও আর এগোবে না। আর এই লকডাউনের বাজারে তেনার সঙ্গে আড্ডাটাও বেশ ভালো জমে। তিনি ভূত না হলেও অদ্ভূত তো বটে। বিক্রম-বেতালের গল্পের বেতালের মতোই সব সময় আমার ঘাড়ে চেপে থাকতে চায়। থুড়ি, ঘাড়ে নয় মাথায়। এখন আবার তাঁর কড়ানাড়া শোনা যাচ্ছে। দেখি, প্রভু কী বলেন। তাঁকে আপ্যায়ন করে বললাম, বলেন কত্তা, আপনার গ্রিক মাইথোলজির গল্প শেষ হল। তিনি বললেন সে কী রে পাগলা, শুধু গ্রিক মাইথোলজি নিয়ে পড়ে থাকলেই হবে, একবার নিজের দেশের দিকে তাকাবি না। বললাম ওরে বাবা, আবার আমার দেশেও আছে নাকি ওই রকম কোনো স্ফিংস বা আনুবিসের মুর্তি? ভাবনাবাবু বললেন, কেন, অত বড়ো বড়ো দুটো চোখ নিয়ে তুই কি গণেশ-বাবাজির মূর্তি দেখতে পাস না। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, সে কী, কোথায় স্ফিংস-আনুবিস আর কোথায় নাদুস-নুদুস গণেশ-ঠাকুর! কামাল করছেন স্যার। ভাবনাবাবু একটু বিষণ্ণ হয়ে বললেন, কেন রে, স্বদেশের দেবতা বলে তাকে তুচ্ছ করতে হবে নাকি? ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস আছে কী নেই সেটা বড়ো কথা নয়, দেবতার মূর্তি-কল্পনার মধ্যে যে একটা ভাবনা কাজ করেছিল সে কথাটা তো মানবি? সেগুলো নিয়েও একটু ভাবতে হয়। তোরা শুধু গ্রিক আর নর্স-মাইথোলজি নিয়ে পড়ে থাকবি। স্বাধীনতার আট দশক হতে চলল এখনো তোরা সাহেবদের নাম শুনলেই মূর্ছা যাস। পারলে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে বসিস। আসলে দেশ থেকে লালমুখোরা বিদেয় হলেও দুশো বছর ধরে সাহেবদের পদসেবা করে তোদের মন-মানসিকতায় সেই দাসত্বভাব এখনো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এটাকে কি বলে জানিস তো? কলোনিয়াল হ্যাংওভার। তো, তোদের এখনো সেই কলোনিয়াল হ্যাংওভার কাটেনি। শোন এই গণেশ-বাবাজির মূর্তি কল্পনাতেও ওই হরপ্পা-প্রভাব রয়ে গেছে। তোদের মুদ্রাদোষ দিয়ে তোরা যা খুশি ভাবতে পারিস, যেমন ভেবে নিয়েছিস আর্য-আগ্রাসনের ফলে ভারতের প্রচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির সব কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছিল; আসল ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়; তোরা তো খুব ইংরেজি-ভক্ত, ইংরেজি তোদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা, সেটা অবশ্য দোষের নয়, কারণ ইংরেজ শাসনের প্রতি ঘৃণা থাকলেও ইংরেজি ভাষাটা তো আর কোনো দোষ করেনি, তো সেই ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে ০old habits die hard , আমাদের বাংলাতেও বলে স্বভাব যায় না মলে; হরপ্পার নগরগুলো ধ্বংস করলেও আর্যপুত্ররা তাদের মানূষগুলোকে তো আর নিকেশ করতে পারেনি। দেশের এখানে-ওখানে সিন্ধু-যুগের প্রাচীন মানুষেরা থেকেই গেছিল। তাদের চেতন-অবচেতনেই বেঁচেছিল নিজেদের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতির জরুরি উপাদানগুলো। সেটা একটা বিশাল লোকসমাজের মধ্যে। তারাই এই গণেশ মূর্তির উদ্ভাবক। বেদ-উপনিষদের যুগে আর্যদের মধ্যে মূর্তি-লূজার প্রচলন আর কোথায়। খেয়াল করে দেখ, গণেশ নামটার মধ্যে গণ-শব্দটা আছে। আর এই গণ মানে যে যে জনগণ সেটা নিশ্চয় আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। এই নাম আর্যদেরই দেওয়া অথচ বৈদিক দেবতাদের সিন্ডিকেটে গণেশ নামের কোনো দেবতার দেখা পাওয়া যায়নি। আবার এদেশে প্রাচীন আর্যদের যে বাসভূমি সেই উত্তর ভারত জুড়ে হাতির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। হাতির আবাস ছিল পূর্ব-ভারতে। এই অঞ্চলের মানুষদের রণহস্তী আছে শুনে ভয় পেয়ে আলেকজান্ডারের সৈন্য দল পর্যন্ত এখানে পা রাখতে সাহস পায়নি। ফিরে গেছিল । সেকথা ইতিহাসে লেখা আছে। এই হস্তি শব্দটার প্রচলনটাও বড়ো মজার । আর্যরা যখন প্রথম হাতি দেখে তখন হাতির কান দেখে তারা সে-দুটোকে হাত ভেবেছিল। তাই সে প্রাণূর নাম করণ হল হস্তী। মানে হাতওয়ালা পশু। লোকায়ত ভাবনায় হাতির মুণ্ড বসানো সেই গণেশের মধ্যে মানুষ আর পশু এই দুই-শক্তির ফিউসন করানো হল। ফলে আমাদের মা-দুগ্গার খোকাবাবুরও শক্তি গেল বেড়ে। বুঝলি হাঁদারাম; এটা কিন্তু পুরোপুরি হরপ্পা-এফেক্ট।
মন্তব্যসমূহ