কে যেন ঘুর-ঘুর করে (১০)

 

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (১০)

মুরারি সিংহ

সে-দিন পাশের ঘর থেকে গিন্নির সঙ্গে কন্যার কথোপকথন কানে আসছিল। শুনলাম মা বেটিকে বলছে, কেশব-নাগের পাটিগণিতে পিতা-পুত্রের বয়সের অঙ্ক আছে, মাতা-পুত্র বা মাতা-কন্যার অঙ্ক আছে কি? আমার গিন্নিটি এই রকমই, মাঝে মাঝে খুব অদ্ভূত কথা বলে। তাতে যেমন বেশ মজা থাকে তেমনি অন্য রকম ভাবনার ঝলকও বেরিয়ে আসে। সেদিন গ্যাস-ওয়ালা গ্যাস নিয়ে এসেছে, সিলিন্ডারটা বেশ পুরোনো রংচটা আর তোবড়ানো, গিন্নি বলে উঠল, ও-মা , এর বয়স তো মোদির চেয়ে বেশি, এমন সিলিন্ডার নেব না যাও; যদিও পরে সেটাই ঘরে ঢুকল। কিন্তু মা-মেয়ের মুখে কেশব-নাগের অঙ্কের কথা শুনে আমার মাথার মধ্যে আবার কী যেন ঘুর-ঘুর করতে শুরু করল। মনে হল, সত্যিই তো এই পুরুষ-শাসিত সমাজে নারী-পুরুষ আমরা তো সকলেই পুরুষতন্ত্রের হাতের ক্রীড়নক মাত্র। সচরাচর সেই-ভাষাতেই কথা বলে থাকি। এখন নাহয় নারী অধিকারের পক্ষে অনেক আন্দোলন হচ্ছে, অনেক জনমত তৈরি হচ্ছে, মহিলাদের ছোটো করার, তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার পুরোনো অভ্যাস থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন; ভাবলাম, আচ্ছা, পুরাকাল থেকে চিন্তার জগৎটা কি পুরুষদের একার অধিকারে? সেখানে কি নারীদের কোনো প্রবেশ-স্বত্ব নেই? সেটা তো হতে পারে না। হয়ওনি। বৈদিক-সমাজে একটা পুরুষ-পুরুষ ভাব ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছিল। তার কারণ হয়ত আর্য-গোষ্ঠীগুলোতে নারীদের সংখ্যা-লঘুত্ব। দুর্গম পথ অতিক্রম করে, নানান প্রাকৃতিক বিপদের মুখোমুখি হয়ে, শত্রুদের সঙ্গে অবিরাম লড়াই করে আর্যগোষ্ঠীগুলো যখন ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, তখন খুব বেশি সংখ্যক নারী সেই অভিযানে তাদের সঙ্গ দিতে পারেনি। যার জন্যে এদশের নারীদের উপরেও আর্যপুত্রদের নেক নজর পড়েছিল। তার উপর অনুমান করা যায়, এদেশীয়দের গড়ে তোলা নাগরিক সভ্যতায় মানুষ হবার কারণে সেই ললনারা আর্যদের মতো আধা-সভ্য ছিল না; বরং তারা ছিল সুসভ্য মার্জিত এবং সংস্কৃতিবান। তাদের বেশভূষা কেশ-বিন্যাস অলঙ্কার-সজ্জাও ছিল অনেক উন্নত। এই প্রসঙ্গে মহাভারতের অন্তত দুটো কাহিনির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একটা রাক্ষস-কন্যা হিড়িম্বার এবং অন্যটি নাগ-কন্যা উলুপির। আমাদের মনে আছে, এই অনার্য-বালাদের রূপে-গুণে মুদ্ধ হয়েই ভীম এবং অর্জুন তাদের পাণিগ্রহণ করেছিল। ফলে আর্য-যোদ্ধারা যখন অনার্য-পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করেছে, তখন অনার্য-নারীদের তারা বন্দি করে দাসী বানিয়েছে, এবং তাদের মধ্যে একটা বড়ো অংশের মহিলা তাদের রূর গুণ ও সৌন্দর্যের জন্যেই আর্যদের অন্দরমহলেও জায়গা করে নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে আর্যদের রুচি-বদলের পিছনে এই অনার্য অন্তঃপুরবাসিনীদের একটা গুরুপূর্ণ ভূমিকা থেকে গেছে। আর্যপুত্রদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের অনার্য মায়েদের কোলেপিঠেই মানুষ হয়েছিল, সেই সূত্রে আর্য-সংস্কৃতির অনার্যয়নেও তাদের দান কম নয়। সম্মুখ সমরে আর্যরা অনার্যদের যতই পরাজিত করুক, তাদের গৃহাশ্রম পরিচালনায় ছিল অনার্য-নারীদেরই জয়জয়কার। যাই হোক, যখন ঋকবেদের স্তোত্রগুলোতে পুরুষদের আধিপত্য প্রকট হয়ে উঠল, বিভিন্ন স্তোত্রে শুধু পুরুষ-দেবতার বন্দনা করে সেগুলো তাদের নামেই উৎসর্গ করা হল, এমনকী সৃষ্টিকর্তাকে পর্যন্ত পুরুষ বানানো হল, স্বাভাবিক কারণেই মনে প্রশ্ন জাগে, তখন তাদের নারী-সমাজ কি একেবারেই চুপচাপ ছিল, না তাদের মতো করে তারা নিজেদের প্রতিবাদ কোথাও লিপিবদ্ধ করেছিল?  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (২)

বাংলা কবিতায় ব্রাহ্মণ্যবাদ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১১)

একটি অনুরোধ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১২)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৫)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৮)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৫)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৭)