কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৯)

 কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৯)

মুরারি সিংহ

চিন্তাশীল মানুষের মগজকে থামিয়ে রাখা যায় না, চিন্তা-প্রবাহকেও রোধ করা যায় না। সেই তরঙ্গকে আটকাতে গেলেই আসে বাঁধ-বাঁধার পালা। রক্ষণশীলরা যুগে যুগে সেটাই করে থাকেন। বৈদিক যুগেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রথম দিকে বেদে যখন বহু-দেবতার অস্তিত্ত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, তখন প্রথম প্রথম বেদের মন্ত্র-দ্রষ্টারা সৃষ্টি এবং সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে একটা ঐকমত্যে পৌঁছতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নানা সংশয় থেকেই যাচ্ছিল; এইখানে দেখা মিলল এমন এক সূক্তের যাতে ইন্দ্র-মিত্র-বরুণ ইত্যাদি-প্রভৃতি দেবতাদের বাদ দিয়ে এক কাল্পনিক পুরুষকে জগতের সৃষ্টিকর্তার আসনে বসিয়ে দেওয়া হল। ঘোষণা করা হল তিনিই জগতের প্রভু, তিনিই বিশ্ব-ব্রহ্মণ্ডের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। সূক্তটি পড়লেই বোঝা যায় সেটি সমাজের রক্ষণশীল কর্তাবাবুদের কাজ। কারণ সেখানে কোনো রকম যুক্তিতর্কের মধ্যে না গিয়ে এমন এক বিশালাকার পুরুষের রূপ কল্পনা করা হল, যাঁর এক হাজার মাথা, এক হাজার হাত, এক হাজার পা; নিজের সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে তাঁর শরীর আরো দশ আঙুল বেড়ে গেছে। কী উদ্ভট এই বিস্তার। সেই পুরুষের গৌরবের তো সীমা-পরিসীমা নেই; পশু-পাখি-গাছপালা থেকে শুরু করে জগতের যাবতীয় বিষয়-বস্তু, চাঁদ-সূর্য-আকাশ-বাতাস এমন কী বেদ এবং তার সমস্ত মন্ত্র, ছন্দ, জগতের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ এবং যাবতীয় জ্ঞান সবকিছুই তাঁর তৈরি করা; সঙ্গে এটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এসব তিনি সৃষ্টি করেছেন যজ্ঞ করে। মানে, সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে মাঝখান থেকে যজ্ঞের পক্ষেও খানিক সওয়াল করা হল। তবে তথাকথিত এই সৃষ্টি-সূক্তের যেটা সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক দিক তা হল, মানূষে মানুষে বিভেদের বীজ বুনে দেওয়া। বলা হল, সেই মহাপুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, ঊরু থেকে বৈশ্য এবং দুটো-পা থেকে শূদ্রদের জন্ম হয়েছে। কী ভয়ংকর কথাবার্তা। ব্যাপারটা বুঝুন, যখন আধ্যাত্মিক উপলব্ধিগুলোকে নানা রকম যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা চলছে, ঠিক তখনই এই রকম কিছু মন্ত্র তৈরি করে সেই প্রগতির ভাবনাতে একটা বড়ো-সড়ো দাঁড়ি টানার চেষ্টা করা হচ্ছে। পণ্ডিতেরা মনে করেন, ঋকবেদ-সংহিতার প্রথম দিকে এই সূক্তটি ছিল না, অনেক পরে তাকে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রক্ষিপ্ত। বোঝাই যাচ্ছে, এটা সমাজের স্বার্থান্বেষী মহলের কাজ। যাঁরা চাইছিলেন বেদের-মীমাংসার অভ্রান্ততা নিয়ে সর্বসাধারণের মধ্যে জোর করে একটা ফরমান চাপিয়ে দিতে। এটাও পরিষ্কার, এই কুকর্মের মধ্যে দিয়েই চিন্তাশীল মানুষের মগজে কার্ফু জারি করে সমস্ত রকম প্রগতিশীল চিন্তাকে রোধ করে দেবার চেষ্টা করা হল। সমস্ত সুস্থ চিন্তাকেই কলুষিত করল এই পুরুষ-সূক্ত। কায়েমি-স্বার্থের যারা ধারক ও বাহক এমন একটা সূক্তকে তারা তো মহাউল্লাসে লুফে নেবেই। হলও তাই, এই সূক্তের কথাগুলোকে চারপাশে ঢাকঢোল পিটিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হল। পরের দিকে, অন্যন্য বেদ-ব্রাহ্মণ-উপনিষদে এই কথাগুলো বার বার উচ্চারিত হল। সমস্ত শিক্ষার্থীকে গায়ত্রী-মন্ত্রের মতো এই মন্ত্রগুলোকেও কণ্ঠস্থ করানো হল। সেই সময়ে যেমন তা করা হয়েছিল, এখন এই একবিংশ-শতকেও সেই অভ্যাসে ভাটা পড়েনি। বরং বহুগুণ বেড়ে গেছে। আজকের ভারতবর্ষজুড়ে যে জাতি-বিদ্বেষের বিষাক্ত পরিবেশ বিরাজ করছে, যার জন্যে সারা পৃথিবীতে দেশের এত বদনাম, তার মূলে কিন্তু এই পুরুষ-সূক্তটি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (২)

বাংলা কবিতায় ব্রাহ্মণ্যবাদ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১১)

একটি অনুরোধ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১২)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৫)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৮)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৫)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৭)