কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৭)
কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৭)
আলোচনা-প্রসঙ্গে বেদের কথা বলছিলাম। বলছিলাম জীবনানন্দের কথাও। সেই দূরবর্তী বৈদিক সময়ে বহু-দেবতার কল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আর্য-ঋষি প্রশ্ন তুলেছিলেন, কোন দেবতাকে হবিষ্য নিবেদন করব; বহু যুগ কেটে যাবার পর আধুনিক-সময়ে এসে ‘মহাপৃথিবীর’-কবি কোনো দেবতা নয়, কোনো হবিও নয়, নিজের হৃদয়ের কাছেই নিবেদন করলেন, তাঁর সংশয়ের কথা। বললেন, ‘আমি সব দেবতারে ছেড়ে/ আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,/বলি আমি এই হৃদয়েরে:’…। বেদের ঋষি যখন প্রশ্ন করেছিলেন, এ-কথা সুবিদিত, সেই সময়ে বৈদিক মীমাংসা নিয়ে কারো প্রশ্ন করার কোনো অধিকারই ছিল না। জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বেদ এমন এক জ্ঞানভাণ্ডার যা কেউ লেখেননি, তা কারো দ্বারা উক্ত নয়, সুতরাং তা উচ্ছিষ্ট নয়, তা অপৌরুষেয় এবং অলঙ্ঘনীয়। বলা হয়েছে, বেদের মন্ত্রগুলি বৈদিক ঋষিরা লেখেননি, তা নাকি তাঁরা স্বপ্নে পেয়েছিলেন। যে-কারণে তাঁরা মন্ত্রের রচয়িতা বা মন্ত্র-স্রষ্টা নন, তাঁদের বলা হল মন্ত্র-দ্রষ্টা। একথাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই বেদবাক্য বা মন্ত্রের অথোরিটি নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না, বললে তাকে বেদ-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। যেমন তাঁরা এ-দেশকে বলেছিলেন অসুর-রাক্ষস-দস্যুদের দেশ এবং এদেশে বসবাসকারী অধিবাসীদের বলেছিলেন ‘শিশ্ন-দেবাঃ’ বা লিঙ্গ-পূজক; বলেছিলেন, এই দস্যুরা যজ্ঞ নষ্ট করে, 'মৃধ্রবাক্’, অর্থাৎ দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলে, তারা ‘অকর্মন্’ অর্থাৎ বৈদিক রীতিনীতি মানে না, ‘অদেবায়ু’ বা দেবতাদের মানে না, ‘অব্রহ্মণ’ বা ভক্তিহীন, ‘অযজবন্’ বা উৎসর্গ মানে না, ‘অব্রত’ বা নিয়ম-বিধি মানে না, ‘অন্যব্রত’ বা নিজেদের নিয়ম মেনে চলে এবং ‘দেবপিয়ু’ বা দেবতাদের গালাগালি করে। সুতরাং এইসব কালো কালো নাকখ্যাঁদা মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা, তাদের সম্পত্তি দখল করা এবং তাদের ধনসম্পদ লুঠ করার অবাধ অধিকার ওই সব গৌরবর্ণ নর্ডিকদের আছে। অথচ এ-দেশীয় মানুষদের দেখে, তাদের আচার-আচরণ দেখে, তাদের ধর্ম-কর্ম দেখে, যাঁরা চেয়েছিলেন বৈদিক-মন্তের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য, সেই মন্ত্র-দ্রষ্টা ঋষিদের কারো কারো ভাবনার জগতেও জোর ধাক্কা লাগল; বোঝা গেল, তাঁদের মনের মধ্যে তখন অন্য চিন্তা ঘুর-ঘুর করেছে। এতদিন তাঁদের ভাবনায় যে একগুঁয়েমি এবং একমুখিনতা ছিল; ভিন্ন-দেশ, ভিন্ন-মানুষজন, ভিন্ন জীবনচর্চার সংস্পর্শ এসে তা আর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল না, বদলাতে থাকল। এইভাবে নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির ঠ্যালায় আর্যদের দর্শন-ভাবনায় অনিবার্যভাবেই একদিন বেদ-বিরোধী প্রশ্ন উঠে এল। জন্ম নিল সংশয়বাদ। সেসব দেখেশুনে আর্য-কর্তারা বোধ হয় একটা বিপদ আঁচ করতে পেরেছিলেন। নিজেদের চিন্তা-সংকট কাটানোর জন্যে তাঁরা সৃষ্টি-মীমাংসার আরো গভীরে যাবার চেষ্টা করলেন, খুঁজতে লাগলেন শুরুরও শুরুতে, অর্থাৎ একদম আদিতে কী ছিল। অনেক ভেবেচিন্তে, যে-সব প্রশ্ন তাঁদের মাথার মধ্যে ঘুর-ঘুর করে তাঁদের মনকে পীড়িত করত, তা ব্যক্ত করা হল এবং তার সম্ভাব্য উত্তরও দেওয়া হল; সৃষ্টি হল ঋকবেদের ‘নাসদীয় সূক্ত’; সেখানে বলা হল, তখন যা নেই তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না; পৃথিবীও ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না। তারপরই প্রশ্ন করা হল, তাহলে সব কিছুকে আবরণ করে এমন কী ছিল? কোথায় কার স্থান ছিল? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল? উত্তরে বলা হল, তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না, রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিল না। কেবল সেই একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারিতা ব্যতিরেকে আত্মামাত্র অবলম্বনে নিশ্বাস প্রশ্বাস যুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বোঝা যাচ্ছে, নতুন গজিয়ে ওঠা এইসব ভাবনা-চিন্তায় বৈদিক-ঋষিরা তখনো যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে একটা সমাধানে পৌঁছোনের রাস্তা খুঁজছিলেন। আর্য-সমাজে রক্ষণশীলতা তখনো শেকড় গেড়ে বসেনি এবং তখনো সেখানে প্রগতিশীল ভাবনাকে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়নি।
(বৈদিক
সূক্তের অনুবাদে রমেশচন্দ্র দত্ত-কে অনুসরণ করা হয়েছে)।
মন্তব্যসমূহ