কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৪)

 কে যেন ঘুর ঘুর করে ()

মুরারি সিংহ  

বেলুনের ভেতর যতক্ষণ হাওয়া আছে ততক্ষণই সে বেলুন, তার গায়ে একটা পিন ফুটিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে সে ‘গেলুম’। পঙ্‌ক্তিটা মনে এল এক সাম্প্রতিক মৃত্যুর ঘটনায়। প্রতিদিনই অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যায়। প্রতিটা মৃত্যুর গায়েই জড়িয়ে থাকে একটা অনিবার্য শোকের আচ্ছাদন। সংশ্লিষ্ট পরিবার দুঃখে কাতর হবে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক, এমনকি যারা সেই মৃত্যুর কাছাকাছি থাকে মৃত্যুর একটা শিরশিরে হাওয়া কম-বেশি তাদেরকেও স্পর্শ করে, কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। এমনিতে মৃত্যুর দর্শন আমাদের কাছে জলভাতের মতোই অতি সহজবোধ্য এবং জ্ঞান হবার পর থেকে জীবনের নিয়ম মেনে আমরা সকলেই মৃত্যু-চেতনার সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে উঠি। নিকটজনের চিরবিদায়ে যখন সেই মৃত্যু অত্যন্ত প্রকট হয়, তখন সব জেনে-বুঝেও আমরা আমাদের শোকের প্রকাশকে আটকাতে পারি না, আটকানোটা বোধহয় ঠিকও নয়। কারণ, সেই মৃত্যুকে ‘পার হয়ে’ আমরা পৌঁছে যাই জীবনের ‘নব-প্রভাতের শিখর চূড়ায়’। কৈশোর-উত্তীর্ন হয়ে মাত্র আঠারো বছর বয়সে বাবার মৃত্যু দেখেছি, খুব কাছ থেকে। তখন সবে কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। নিকট জনেদের মধ্যে তারপর একে একে বড়োমা (জ্যাঠাইমা), মায়ের মৃত্যু দেখেছি; এই সেদিন, আট বছর আগে সামান্য সময়ের ব্যবধানে দুই সহোদর বড়দা ও ছোড়দাকেও চলে যেতে দেখলাম। প্রতিবারই শ্মশানে গেছি, তাকিয়ে থেকেছি চিতার লেলিহান শিখার দিকে; দেখেছি কী ভাবে, একটা প্রিয় শরীরকে একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে সেই সর্বভুক হুতাশন।  অগ্নি-গ্রাসে পুড়তে পুড়তে রক্ত-মাংসের ডেডবডি আস্তে আস্তে কতকটা ছাইয়ে পরিণত হচ্ছে। চিতাগ্নির পাশে বসে থাকতে থাকতে কত কথা, কত স্মৃতি, মনে এসেছে। তারপর ফিরে এসে স্নান করে, নিমপাতা চিবিয়ে, প্রচলিত প্রথা মেনে আগুন ও গোবরকে স্পর্শ করে ঘরে ঢোকা। অশৌচকালীন কৃচ্ছ্রতা-সাধন করে, চুল-নখ কেটে, নতুন বস্ত্র পরে, শ্রাদ্ধ-শান্তি করে, লোকজন খাইয়ে, শোক-পর্ব শেষ হয়েছে। কিন্তু শোক কি শেষ হয়? এই তো সেদিন, মাত্র এক সপ্তাহ আগে বড়ো দিদিও আমাদের মায়া কাটালো। খবর পেয়ে আরামবাগ ছুটেছিলাম, সহোদরাকে শেষ দেখা দেখতে। এক রাশ মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বয়স যত বাড়ে, স্মৃতি-রাশি বেড়ে যায়, তার একটা বড়ো অংশ জুড়ে থাকে এইসব শোককথা, শোকগাথা। মাঝে মাঝেই তারা মাথার মধ্যে ঘুর-ঘুর করে। গ্রামে ফেরার পর এখন মাঝে মাঝে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পারিবারিক শ্মশানের কাছে গিয়ে বসি। বাবা-মা-দাদাদের মনে করে চোখে জল আসে। সেই নিভৃতে খানিক কেঁদে নিই। দেখি, বর্ষার জল পেয়ে শ্মশানভূমিতে এখন প্রচুর নতুন ঘাস গজিয়েছে। তার উপর এসে পড়ে সূর্যাস্তের আলো। একা একা বসে থাকি। অনেকক্ষণ। ভাবি, একদিন এখানে আমার নশ্বরদেহও একমুঠো ভস্মে পরিণত হবে। কে জানে, শেষের সে-দিন আর কত দূর…। তারপর শ্মশান-বৈরাগ্যের পালা শেষ করে একসময় আবার ফিরে আসতে হয় সুখি-গৃহকোণে।          

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (২)

বাংলা কবিতায় ব্রাহ্মণ্যবাদ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১১)

একটি অনুরোধ

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১২)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৫)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৮)

কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৫)

কে যেন ঘুর ঘুর করে (১৭)