কে যেন ঘুর-ঘুর করে (৩)
কে যেন ঘুর ঘুর করে (৩)
/ মুরারি সিংহ
‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক, এই দুনিয়া ঘুরে বনবন বনবন ছন্দে ছন্দে
কত রং বদলায়, রং বদলায় …’; ‘মাথার মধ্যে
কী যেন ঘুর ঘুর করে’ ভাবতে গিয়ে আজ হঠাৎ এই গানের কলিগুলো মাথায় এল, মানে ঘুর-ঘুর
করতে শুরু করল। সমস্ত দিন সেই সুরেই বিভোর হয়ে আছি। মনে হচ্ছে, সত্যি এই দুনিয়া এক
দুরন্ত-ঘূর্ণি-পাক। ছত্রিশ-বছর। দেখতে দেখতে এতগুলো দিন কোথা দিয়ে কেটে গেল,
বুঝতেই পারলাম না। চাকুরি-পর্ব শেষ করে এত দিন পরে যখন গ্রামে ফিরলাম, সে এক নতুন
অভিজ্ঞতা। মনে হল, নিজেরই মাতৃভূমিতে, যেখানে আমার কৈশোর কেটেছে, প্রথম যৌবনেরও
কিছুদিন, আজ যেন তা এক অতি দূর নক্ষত্রর দেশ। যে-মাঠে একদিন খেলাধূলা করেছি, যে-সব
জায়গায় একদিন তুমুল আড্ডা দিয়েছি, গল্প করেছি, আজ তা নতুন প্রজন্মের দখলে। গল্পের
রিপ-ভ্যান-উংকিল বিশ বছর পরে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল, আমার কাছে এখন যেন তা এক
বিদেশ। ছত্রিশ-বছর পরে এই লকডাউনের বাজারে আজ নিজেরই ভিটেমাটিতে আরেক
রিপ-ভ্যান-উংকিল হয়ে আমি যেন আবার নতুন করে জেগে উঠলাম, বা বলা ভালো জন্ম নিলাম।
সেই হিসাবে এ আমার দ্বিতীয় জন্ম। তার মানে এতদিন কি আমার মৃত্যু হয়েছিল? তা তো নয়।
এটা ঠিক, জীবন ও জীবিকার টানে একদিন আমাকে নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছিল।
স্থানান্তরযোগ্য সরকারি চাকরির সেটাই ছিল অলিখিত শর্ত। দেশ মানে গ্রাম ছেড়েছিলাম।
কিন্তু এটা তো ঠিক নয় তার জন্যে আমি গ্রামের সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে
দিয়েছি। ছুটি-ছাটায়, উৎসবে পার্বনে আমি নিয়মিত গ্রামের বাড়িতে ছুটে এসেছি।
সপরিবারে। আমার ছেলেমেয়ে বা গিন্নিও এ-ব্যাপারে কোনোদিন অনীহা দেখায়নি। বরং
প্রতিবারই তাদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। ছেলেমেয়ে বাইরে থেকেই বড়ো হয়েছে,
লেখাপড়া করেছে। কিন্তু তাদের বিয়ে দিয়েছি গ্রামের বাড়ি থেকে। মেয়ের বিয়েতে তো গোটা
কবিতাপাক্ষিক পরিবারই আমন্ত্রিত ছিল। সেই সুবাদে এসেছিলেন প্রভাতদা ও বৌদি, নাসের,
গৌরাঙ্গ-রীতা এবং আফজল। চুটিয়ে আনন্দ হয়েছিল। বিয়ে উপলক্ষে কপা থেকে ‘বিবাহমঙ্গল’
বলে একটা পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে অনেকেই লিখেছিলেন। সে-সব এখন অমূল্য
স্মৃতির অ্যালবাম হয়ে আছে। পারিবারিক অ্যালবামেও তার সব ছবি আছে। আমি কিন্তু ইচ্ছে
করলে বর্ধমান বা কলকাতা শহরে এসবের আয়োজন করতে পারতাম। সেটা আমার পক্ষে অনেক বেশি
সহজও হত। কিন্তু করিনি। বাবা-মা বা পিতৃপুরুষের স্মৃতির একটা আবেগ কাজ করেছিল। তা
না করলে আমার ভিটেতে এত গুণিমানুষের পদার্পণও ঘটত না। আজ নাসের গৌরাঙ্গ চলে গেছে। প্রভাতদা
কিছুটা অসুস্থ। কিন্তু আমার মতো একজন মামুলি মানুষের বাড়িতে তাদের স্পর্শ রয়ে
গেছে। তা ছুঁয়ে আমি এখনো আনন্দ পাই, নিজেকে ধন্য মনে করি। আত্মখনন করতে গিয়ে দেখি,
এই অবসর জীবনে সে-সব স্মৃতিকথাও আমার মাথার ভিতরে ঘুর-ঘুর করে।
মন্তব্যসমূহ